অভিশংসন দণ্ড থেকে এবারও রেহাই পেলেন ট্রাম্প

1178
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো অভিশংসন দণ্ড থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। সিনেটের অভিশংসন আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ট্রাম্পকে দণ্ড দেওয়ার পক্ষে ভোট দেন। তবে তিনি সাংবিধানিক আইনে রেহাই পেয়েছেন।

দণ্ড আরোপের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সিনেট সদস্যের ভোট দরকার। কিন্তু সেই ভোট পড়েনি। ফলে অভিশংসন আদালতের চূড়ান্ত ৫৭-৪৩ ভোটের মাধ্যমে দণ্ড থেকে এ দফাও বেঁচে যান ট্রাম্প।

আদালতের সিদ্ধান্ত জানার পর সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, সামনে অনেক কাজ। আমেরিকার উজ্জ্বল ও সীমাহীন সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে দ্রুতই তাঁর আগমন ঘটবে বলে ট্রাম্প উল্লেখ করেন।

জানুয়ারিতে প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি সিনেটে অভিশংসন আদালতের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে থেকে অভিশংসন দণ্ড কার্যকর করার জন্য সিনেটে আদালত বসেন। শুরুতেই সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রস্তাব পাঠ করা হয়।
ক্যাপিটল হিলে হামলার মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে প্ররোচনা ও উসকানির অভিযোগে সিনেটে ট্রাম্পের দ্বিতীয় অভিশংসনের বিচার অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু রিপাবলিকান সিনেটরদের প্রয়োজনীয়সংখ্যক ভোট না পাওয়ায় বিচারে ট্রাম্পকে দণ্ডিত করা যায়নি। এমনটা যে ঘটবে, তা বিচার শুরুর আগেই প্রতীয়মান হয়েছিল। রিপাবলিকান বেশির ভাগ সিনেটর ট্রাম্পের বলয়ের বাইরে গিয়ে এই অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেবেন না বলে আগেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।

৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার জন্য দায়ী করে আনা অভিযোগ অভিশংসনযোগ্য বলে ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। ট্রাম্পের পক্ষে তাঁর আইনজীবীরা যুক্তিগুলো খণ্ডন করেন।

অভিশংসন বিচারের জন্য মার্কিন সিনেটের ১০০ জন সদস্যই শপথ নিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে অভিশংসন আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ট্রাম্পের আইনজীবীরা সমাপনী বক্তব্য দেন।

অভিযোগ প্রমাণের জন্য আদালতে উপস্থাপিত বক্তব্যের বাইরে সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হবে কি না, তা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়। কোনো সাক্ষ্য ডাকার প্রয়োজন নেই মর্মে সমঝোতা হলে বিচারিক কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে সমাপ্তের দিকে চলে যায়।

বিচার নিয়ে উত্তেজনা ছিল। কিন্তু বিচারের ফলাফল অনেকটাই প্রত্যাশিত ছিল।

অভিশংসন আদালতের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা প্রবীণ ডেমোক্র্যাট সিনেটর প্যাট্রিক লেহি দণ্ড আরোপের জন্য ভোট আহ্বান করেন।

আগের অবস্থান থেকে একজন রিপাবলিকান সিনেটর তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করে ভোট প্রদান করেন। ফলে সাতজন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। তাঁরা হলেন সিনেটর রিচার্ড বার, বিল কেসেডি, সুজান কলিন্স, লিসা মারকাউস্কি, মিট রমনি, বেন সাসেই ও প্যাট টোমি।

প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পের অভিশংসন প্রস্তাবের পক্ষে ১০ জন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ভোট প্রদান করেছিলেন।

সিনেটে অভিশংসন দণ্ড দেওয়ার পক্ষে ভোট দেওয়া রিপাবলিকান সিনেটরদের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে। অঙ্গরাজ্য রিপাবলিকান কমিটি থেকে এসব আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার শুরু হয়েছে।

ট্রাম্পের ছেলে ট্রাম্প জুনিয়র এক টুইটবার্তায় বলেছেন, এখন দলের তালিকায় নাম থাকা এসব রিপাবলিকানকে উচ্ছেদ করার কাজ শুরু হবে।

সিনেটে অভিশংসন দণ্ড কার্যকর করার জন্য ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরের সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। এই সমর্থন না থাকার কথা আগে থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল।

সিনেটর রিচার্ড বার বলেছেন, প্রথমে তাঁর অবস্থান ছিল, সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর অভিশংসন দণ্ড কার্যকর করার কোনো সুযোগ নেই। সিনেটে এ নিয়ে ভোট হয়ে যাওয়ার পর তিনি আদালতে উপস্থাপিত বিষয়কে বিবেচনা করেছেন।

রিচার্ড বার বলেছেন, অভিশংসন আদালতে সহিংসতার ও রাষ্ট্রক্ষমতা জোরপূর্বক দখলের জন্য ট্রাম্পের চেষ্টা প্রমাণিত হয়েছে বলেই তিনি পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

অভিশংসন আদালতে রায় ঘোষণার পর সিনেটে রিপাবলিকান পার্টির নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ৬ জানুয়ারি বা তার আগে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ম্রিয়মাণ হয়ে যায় না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সিনেটররা আজকের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সাংবিধানিক দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন বলে সিনেটর মিচ ম্যাককনেল উল্লেখ করেন।

ট্রাম্পের কঠোর সমালোচনাও করেছেন মিচ ম্যাককনেল। তিনি বলেন, নীতিগত ও বাস্তবসম্মতভাবে ট্রাম্প এ ঘটনার জন্য দায়ী।

সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ডেমোক্র্যাট চাক শুমার ভোটের পর তাঁর সিনেটে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, জাতি রিপাবলিকান-বন্ধুদের আজকের এই ভূমিকার কথা কোনো দিন ভুলবে না।

যে সাতজন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের দণ্ডের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের স্যালুট জানিয়ে চাক শুমার বলেন, ‘আপনারা যা করলেন, আমি জানি, কাজটি খুব সহজ নয়। তবে আপনারা সঠিক কাজটি করেছেন। দেশ ও জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাদের আজকের এই ভূমিকার কথা স্মরণ করবে।’

প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এক বিবৃতিতে রিপাবলিকান যেসব সিনেটর ট্রাম্পকে দণ্ড দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছেন।

যাঁরা ট্রাম্পকে অভিশংসন দণ্ড না দেওয়ার জন্য ভোট দিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, আমেরিকার ইতিহাসে তাঁদের কর্ম একটা কালো ইতিহাস হয়ে থাকবে।

পাঁচ দিনব্যাপী চলা অভিশংসন আদালতে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান অভিশংসন ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কংগ্রেসম্যান জ্যামি রাস্কিন ছিলেন সবার নজরে। অভিযোগ উপস্থাপন থেকে শুরু করে সমাপনী বক্তব্য দেওয়া পর্যন্ত জ্যামি রাস্কিন নিজেকে একজন দক্ষ আইনপ্রণেতা হিসেবে প্রমাণ করেন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন ও অভিযোগ প্রমাণের জন্য দেওয়া তাঁর যুক্তিগুলো সমাদৃত হয়েছে।

৬ জানুয়ারির ঘটনার আগের দিন নিজের অকালপ্রয়াত ছেলেকে সমাহিত করে এসে মেয়ে-জামাতাসহ ক্যাপিটল হিলে তাণ্ডবে পড়া নিয়ে জ্যামি রাস্কিনের আবেগঘন বক্তব্য আমেরিকার সাধারণ লোকজনকে স্পর্শ করেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও জ্যামি রাস্কিনকে অভিশংসন আদালতের নায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিশংসন আদালতে ট্রাম্পের দণ্ড কার্যকর করা না গেলেও দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, তাঁর (ট্রাম্প) বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিযোগ নৈতিক অবস্থান থেকে প্রমাণিত হয়েছে।

ট্রাম্পের আইনজীবী মাইকেল ভ্যান ডের ভিন বলেছেন, ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে আনা অভিযোগ প্রমাণে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। ভিডিও উপস্থাপন করে, পুরোনো টুইট বার্তা উপস্থাপন করে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

উপস্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে কোনো তদন্ত করা হয়নি উল্লেখ করে মাইকেল ভিন বলেন, সংবিধান অনুযায়ী কোনো প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করার যথাযথ প্রক্রিয়া গ্রহণ করতেই ডেমোক্রেটিক পার্টি ব্যর্থ হয়েছে।

অভিশংসন আদালতে বিচার্য বিষয় ছিল ট্রাম্প সহিংসতার জন্য সরাসরি কোনো নির্দেশ দিয়েছেন কি না। অথবা ট্রাম্প সহিংসতা করে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করেছেন কি না।

আইনজীবী মাইকেল ভ্যান বলেন, এসব অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টি ব্যর্থ হয়েছে।

ট্রাম্প এক বিবৃতিতে তাঁর আইনজীবীসহ যাঁরা বিচারকে ‘সমুন্নত’ রেখেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেটের যেসব সদস্য তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

২০ জানুয়ারির পর থেকে পরিবার নিয়ে ফ্লোরিডার মার-এ-লাগোতে অবস্থান করছেন ট্রাম্প। অভিশংসন দণ্ড থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ট্রাম্প শিগগিরই রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরে আসছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ট্রাম্প নিজেই তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি তাঁর বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট’ আন্দোলন এগিয়ে যাবে। এ আন্দোলন মাত্র শুরু হয়েছে।

ক্ষমতা ছাড়লেও এখন পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির কেন্দ্রেই রয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর অন্য সব আইনি ঝামেলা হয়তো শুরু হবে আগামী দিনগুলোয়।

রিপাবলিকান পার্টির মধ্যপন্থীরা এখনো ঠিক ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারছেন না।

এদিকে অভিশংসন আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর ট্রাম্পকে নিয়ে কিছুদিন নিস্পৃহ থাকার কথা বলা হচ্ছে জো বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে। নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় এলেও এখনো আমেরিকার রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে ট্রাম্প। এ অবস্থা থেকে বাইডেন প্রশাসন ঘুরে দাঁড়াতে চায়।

করোনা টিকা প্রদানসহ আমেরিকাব্যাপী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, ক্ষুদ্র ব্যবসা চালু করা ও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত লোকজনকে সহায়তা করার ব্যাপক আয়োজন নিয়ে কর্মচাঞ্চল্য শুরু করা হচ্ছে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

অভিশংসন দণ্ড থেকে মুক্তি পেলেও অভিশংসন প্রস্তাব ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গৃহীত হয়েছে। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আইনপ্রণেতা ট্রাম্পকে অভিশংসিত করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

অভিশংসন আদালতে ট্রাম্পের দণ্ড কার্যকর না হলেও তাঁর কৃত অপরাধ আমেরিকার লোকজন ভুলে যাবে না বলে ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আমেরিকার ইতিহাসে দুই দফা অভিশংসনে পড়া সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প চিহ্নিত হয়ে থাকবেন বলে বলা হচ্ছে।

মার্কিন সিনেটে ট্রাম্পের অভিশংসন আদালতের রায়ের মাধ্যমে কার্যত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের নতুন যাত্রা শুরু হয়েছে বলে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম বলেছে। সব মন্দ কাজের জন্য পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর দায় চাপানোর বদলে নিজেদের কাজকে প্রকাশ্য করার জন্য উদারনৈতিক সংবাদমাধ্যম থেকে বাইডেন প্রশাসনকে পরামর্শ দেওয়া শুরু হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম পলিটিকো বলেছে, ইচ্ছা করলেও বাইডেন প্রশাসনের জন্য এই কাজ কঠিন হবে। ট্রাম্প জাতীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব কাজ করে গেছেন, বহু ক্ষেত্রেই তার উল্টো অবস্থানে যেতে হবে বাইডেন প্রশাসনকে। ফলে ট্রাম্পের কথা ও কৃতকর্ম নিয়ে আলোচনা থেকে তাদের বেরিয়ে আসার সুযোগ কম।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন