ঝটিকা সফরে ঢাকায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ৬ ইস‌্যুতে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ

1141
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

একদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর। বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) সকাল ১০টায় বিশেষ ফ্লাইটে দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। আজ রাতেই আবার দেশে ফিরে যাবেন তিনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বঙ্গবন্ধু এয়ারবেজে তাকে স্বস্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

সকাল সাড়ে ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন জয়শঙ্কর। বিকেল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।

আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফর সামনে রেখে ড. এস জয়শঙ্কর ঢাকায় এসেছেন। মোদীর সফরকালে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আলোচনা ও সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত করতেই তার এই সফর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় আসছেন। আর আগামী ২৭ মার্চ দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হতে পারে। এর আগে গত ১৭ মার্চ দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকায় সফরের পরিকল্পনা ছিল। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় সেই সফর হয়নি।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, মোদির সফরে কানেক্টিভিটি, বাণিজ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও কোভিড-পরবর্তী সময়ে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া ভারত থেকে আমাদের প্রচুর কাঁচামাল আসে। এজন্য আমদানি-রফতানি বাধা দূর করার বিষয়ে আলোচনা হবে। ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসছেন। এদিন ঢাকা-জলপাইগুড়ি রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল যৌথভাবে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করবেন দুই প্রধানমন্ত্রী। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন মোদি। ২৭ মার্চ উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। মোদির সফরসূচির বাকি বিষয়গুলো আজ দুদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে চূড়ান্ত হবে।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, দিল্লির পক্ষ থেকে আগ্রহ দেখানো হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে মতুয়া মহাসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও মতুয়া ধর্মমতের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়ি পরিদর্শন, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পরিদর্শন, বরিশালের শিকারপুরে সুগন্ধা শক্তিপীঠ পরিদর্শন, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী পরিদর্শন, ট্রানজিট ইস্যু প্রভৃতি। এসব বিষয় মোদির সফরে সম্ভাব্য বিষয়সূচি হিসেবে আলোচনার জন্য এরই মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটের মৌসুমে মোদি ঢাকা সফরকে রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার করতে চাইছেন। ২৭ মার্চ থেকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন শুরু হচ্ছে। আট দফার ভোট শেষ হবে ২৯ এপ্রিল। এ সময়ে মোদির ঢাকা সফর এবং হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতে যেতে চাওয়া, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের একটি অংশে বিপুলসংখ্যক মতুয়া সম্প্রদায়ের বসবাস। উত্তর চব্বিশপরগনা ও নদীয়ার মতো জায়গায় মতুয়া ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর। এ পরিস্থিতিতে মতুয়ার ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা হরিচাঁদ ঠাকুরের বাড়িতে যেতে চান মোদি। সেখানে গেলে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়কে একটি বার্তা দিতে পারবেন তিনি।

একদিনের সফরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে পানি, বাণিজ্য, সীমান্ত, কানেক্টিভিটিসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানা গেছে। নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরালো করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা হবে। এদিন চূড়ান্ত হবে ঢাকা সফরকালে মোদি কোথায় কোথায় যাবেন। কারণ মোদির সফরে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সূচি চূড়ান্তের প্রতি জোর দিচ্ছে ঢাকা।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি নিয়ে এখনও অনেক বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে। মোদির সফরে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচনা করতে চায় ঢাকা। তিস্তাসহ অন্য ছয়টি নদী, রহিমপুর খালসহ পানি নিয়ে অন্যান্য যে অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, সেগুলো আলোচনায় স্থান পেতে পারে ঢাকার পক্ষ থেকে। এ ছাড়া মনু, মুহুরী, দুধকুমার, ধরলা, গোমতী ও খোয়াই নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে একটি খসড়া চুক্তি নিয়ে কাজ চলছে এবং সেটি দ্রুত শেষ করতে চায় ঢাকা। কুশিয়ারা নদীর পানি সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য রহিমপুর খাল খননে ভারত আপত্তি করছে। এ বিষয়টিও নিষ্পত্তির জন্য আলোচনা করবে ঢাকা।

আঞ্চলিক সহযোগিতা ও কোভিড-পরবর্তী সময়ে সহযোগিতা নিয়েও মোদির সফরে আলোচনা হবে। এ ছাড়া ভারত থেকে আমাদের প্রচুর কাঁচামাল আসে। এই মালামালের জন্য আমদানি-রফতানি বাধা দূর করার বিষয়েও আলোচনা হবে। দুদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশের রফতানিও বাড়ছে। কিন্তু একই সঙ্গে পাটের ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক, স্থলবন্দর সমস্যা, অশুল্ক বাধাসহ অন্যান্য অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। ভারতের আরোপিত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার এবং স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠানো সংক্রান্ত জটিলতা দূর করার বিষয়ে আলোচনা চায় বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মোদির সফরের আগে আগামী ৭ ও ৮ মার্চ দুদেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়েও এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ চুক্তির জন্য একটি যৌথ ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য এর আগে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি দ্রুত শুরু করার জন্য তাগিদ দেবে ঢাকা। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দুদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা হয়। মোদির সফরে বিষয়টি আবারও আলোচনা করতে চায় ঢাকা। ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় হাইওয়েতে সংযুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ঢাকার প্রস্তাব নিয়েও দুপক্ষ আলোচনা করবে। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের মধ্য দিয়ে যোগাযোগের জন্য পাঁচটি নতুন রুটের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ, যা ভারতের বিবেচনাধীন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ও সমুদ্র অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর সবসময় আমাদের কাছে গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন করব আমরা উভয় দেশই। যদিও নরেন্দ্র মোদি আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আসছেন, তবুও বন্ধুদেশ হিসেবে আমাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। মন্ত্রী বলেন, বাণিজ্য ইস্যু এবং কানেক্টিভিটির বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানে যাওয়ার বিষয়ে আমরা অনুরোধ করেছি এবং ভারত বিষয়টি বিবেচনা করছে। আমাদের পক্ষ থেকে একটি নতুন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড রোডে সংযুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ। আশা করি এসব বিষয় এই সফরে আলোচনায় আসবে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন