নেতৃত্ব খরায় বিএনপি

1199
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

মো. শফিকুল ইসলাম: রাজনৈতিক কৌশল ও সুনিদিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা রাজপথে রার বার নিজেদের জানান দিতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে একের পর এক ইস্যু নাকের সামনে চলে এলেও সক্রিয় ভাবে মাঠে নামতে দাঁড়াতে না দলটি। কারণ বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বে জনগণের আস্থা পাচ্ছে না। ঠিক তেমনিভাবে দলের শীষ নেতাদের উপরও আস্থা রাখতে পারছেন না তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ঘরোয়া গন্ডি ও লন্ডন থেকে পরিচালিত হচ্ছে দলটি। আট হাজার মাইল দূরে বসে দেশের রাজনীতি পরিস্থিতিও বোঝা কঠিন। তাই সঠিক দিকনিদের্শনা অভাবে রাজপথে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না দলটি। মুলত যোগ্য নেতৃত্বের খরায় ভুগছে দলটি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল, সন্দেহ নেই। জনসমার্থকও বেশি। কিন্তু জনগণের ভাষা বুঝতে পারছেন না তারা। জনগণ কি চায় তা আগে বুঝতে হবে। নতুন ভাবে চিন্তা করতে হবে। নতুনত্ব সংযোজন করতে হবে। তাহলেই কর্মসূচিতে জনগণ আসবে। অতীতের অগ্নিসন্ত্রাস, জ্বালাও পোড়াও মারামারি রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। হানাহানি মামলা হামলার ভয়ে ‘সীমিতভাবে সক্রিয়’ রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করছে। একই সাথে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে দলটির রাজনৈতিক অঙ্গনে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তার নেতৃত্বও পুরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাদের রাজনীতি নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ও জাতীয় প্রেসক্লাব বা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর মানববন্ধনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

তারা আরো বলেন, সরকার মাঠের রাজনীতির অনেক ইস্যু তাদের হাতে তুলে দিয়েছে কিন্তু জোরালো ভাবে জানান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের নেতা জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিল সহ সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও দায়সারা কর্মসূচি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন নেতারা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ইস্যু তৈরি করতে না পারা এবং অন্যদের ইস্যুকে পুঁজি করতে না পারাটা দলটির অক্ষমতা কি না।

এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্যর প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চোধুরী দিন পরিবর্তনকে বলেন, বিএনপি দলে অনেক নেতা আছে। কিন্তু দল নিয়ন্ত্রণ করেন তারেক রহমান। দেশেও আসতে পারছেন না তিনি। নেতাকর্মীদের সামনে থেকেও নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। কারণ দেশে আসা মাত্রই আটক করে কারাগারে পাঠাবে সরকার।

তিনি বলেন, দেশের বাস্তবতা চিন্তা করে দলের নেতাদের রাজপথে নামা উচিত। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করতে হবে। বিএনপির নেতৃত্বে যারা আছেন তারা অনেক সময় সিধান্ত না নিয়ে চুপ থাকেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এই প্রতিবেদককে বলেন, বিএনপির নেতৃত্ব সংকট রয়েছে। সরকারের রোষানলে পরে অনেকে বিদেশে আছেন। আবার অনেক নেতাকর্মী কারাগারে আছেন। একই সময়ে সাংগঠনিক ভাবে অনেক দুর্বল হয়েছে। তাই রাজপথে আন্দোলনের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্বে অভাব বোধ করছে বিশাল জনসমার্থক দলটি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, যেকোনো ইস্যুতে সীমিতভাবে সক্রিয় থাকে বিএনপি। কেননা দলটির নেতৃত্ব সংকট রয়েছে। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দল হয়ে উঠতে না পারলে জনমানুষের সমস্যা নিয়ে যে চাহিদা তার নেতৃত্ব বিএনপি দিতে পারবে না। তিনি বলেন, প্রথমত- বিএনপির মতাদর্শ ও উত্থান কতটুকু গণতান্ত্রিক, তা পরিষ্কার নয়। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলটি সাংগঠনিকভাবেও দুর্বল। দলটিকে এখন কে চালাচ্ছে? লন্ডন থেকে নাকি গুলশান থেকে? নাকি অটোমেটিক চলছে? আমার মনে হয় সাংগঠনিক শক্তি ও ক্রেডিবিলিটির অভাব রয়েছে।

এদিকে তৃণমুলের নেতারা বলছেন, যেকোনো আন্দোলনের জন্য সবসময়ই প্রস্তুত তারা। তবে তার আগে দরকার দলের যোগ্য নেতৃত্ব ঠিক করা। রাজপথে দুর্বার আন্দোলনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত রয়েছেন নেতাকর্মীরা। এজন্য আর কালক্ষেপনে পক্ষপাতিও নন তারা। তাই সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা।

জানা গেছে, দলের সঠিক নেতৃত্বের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সহ কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন কেউ কেউ। আট হাজার মাইল দূরত্বে থেকে তারেক রহমান নিজে নিরাপদে আছেন। কিন্তু দেশের রাজপথের নেতাকর্মীরা মামলা হামলায় পর্যুদস্ত হয়ে ক্রমেই হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন। অথচ তারেক রহমান শুধু সংগঠন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কাজ করছেন। একই সাথে স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তী পালন ও সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রস্তুত হওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। দলের এমন আহবান সাড়া ফেলেছে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূলেও।

বিএনপি নেতারা বলছেন, অতীত আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য দলের নেতাদের দায় রয়েছে। তাই রাজধানীসহ সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। বর্তমানে অনেক নেতাকেই আমরা দলের প্রয়োজনে পাই না তবে দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তুললে এবার বিএনপি সফল হবেই।

এবিষয়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি রাহাদুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, ইন্টারনেট নির্ভর রাজনীতিতে কে কই থেকে আন্দোলনের ডাক দেবেন আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নেতাকর্মীরা জীবন উৎসর্গ করবেন! নেতারা এখনো বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি, তাদের পিছনে কে দাঁড়াবে আর কে সাড়া দেবে। আমরা চাই তারেক রহমান দেশে ফিরে আসুক। জেল-জরিমানা সহ্য করতে হলেও দেশের সর্বোচ্চ আসনটিও তার জন্য অপেক্ষা করছে বলেও জানান তিনি।

বগুড়ার গাবতলী পৌরসভার মেয়র ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক সদস্য সাইফুল ইসলাম জানান, বর্তমানে দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। এখন অপেক্ষো শুধু নির্দেশের। কেন্দ্র থেকে আন্দোলনের ডাক দিলে যেকোনো মুহূর্তে সরকারের পতন হবে।

শরিয়তপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সাঈদ আহমেদ আসলাম বলেন, বিএনপি যদি কারো অপেক্ষায় বসে থাকে তাহলে বিএনপি কখনো লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। বিএনপি নেতারা এগিয়ে আসলে জনগণও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসবে। আন্দোলনের জন্য তৃণমূলের নেতাকর্মীরা প্রস্তুত। তারেক রহমান যখন আন্দোলনের ঘোষণা করবেন তখন থেকেই আন্দোলন শুরু হবে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নেতৃত্বের বিষয়ে তারেক রহমান ইজ অবভ্যিয়াস। জনগণও বিএনপির পক্ষে আছে। কিন্তু দেশের ভেতরের পাওয়ার সেন্টারগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষ নেওয়ায় জনগণ বিএনপিকে ভোট দিতে পারছে না। এই পাওয়ার সেন্টারগুলোর নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য পাওয়ারফুল দেশগুলোর নিরপেক্ষ অবস্থান দরকার। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই আমাদের কাজ করতে হবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো ফুঁ দেয়া মাত্রই আমরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বো।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় বলেন, আন্দোলন শুরু হয়েছে। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন কর্মসূচি চলবে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হোসেন মাহমুদ টুকু বলেন, অনেকে মনে করেন রাজনীতি মানে মাঠে সহিংসতা দেখানো। কিন্তু আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করছি। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চলছে।

জনগণকে সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনগণ তো সরকার ও পুলিশের ভয়ে সিটিয়ে আছে। বর্তমানে ক্ষমতা প্রদর্শন ও অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে। জনগণ মাঠে নামলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। পুলিশও চাকরির ভয়ে এসব করতে বাধ্য হচ্ছে। জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা রাজনৈতিক দলের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রবল আন্দোলন হলেই কেবল তারা মাঠে নামবে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন