দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীকে গুরুত্বপূর্ন মেডিকেল ডিভিশনে পদায়ন!

1934
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক:
আলোচিত গণপূর্ত অধিদপ্তরে আবারও বদলী বানিজ্য শুরু হয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার এক আদেশে একসঙ্গে ৮ জন নির্বাহী প্রকৌশলীকে বদলী করেছেন। এর মধ্যে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হওয়া একজন নির্বাহী প্রকৌশলীকে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ডিভিশনে পদায়ন করা হয়েছে। ঢাকায় কর্মস্থলে একবছর আগে যোগ দিয়েছেন এমন কর্মকর্তাকেও বদলী করা হয়েছে। এনিয়ে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। অবশ্য সমালোচনা হওয়ার পর বদলী আদেশের মাত্র একদিন পরে দুই জনের বদলী আদেশ স্থগিত করেছেন প্রধান প্রকৌশলী। তবে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হওয়া কিশোরগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজমুল হককে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল ডিভিশনে পদায়ন করায় হতবাক হয়েছেন কর্মকর্তারা।

সংস্লিষ্টরা জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী আজমুল হক ২০১৮ সালে কিশোরগঞ্জের নতুন জেলা কারাগার নির্মাণকাজ অন্তত ৩০ ভাগ কাজ বাকি থাকলেও জুন ক্লোজিংয়ে প্রকল্প কাজ সমাপ্তের ঘোষণা দিয়ে বরাদ্দের ৭৯ কোটি টাকার বিল দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। জেলা প্রশাসক গঠিত তদন্ত কমিটি তখন জানিয়েছিল নিন্মমানের কাজ করার পরও কাজ সমাপ্ত না করে পুরোবিল পরিশোধ করে প্রকল্প সমাপ্তের পায়তারা করা হয়েছে । ২০১৮ সালের মাসে কাজের ৯৫ ভাগ অগ্রগতি দেখিয়ে কাজের বিপরীতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমুদয় টাকা পরিশোধ করে দেয় গণপূর্ত বিভাগ। এ পর্যায়ে নতুন জেলা কারাগারের উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক করতে ডিআইজি প্রিজন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ করে। এ ঘটনার পর সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর হুছাইনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী। এ তদন্ত কমিটি ঐবছরের ৬ জুলাই সরেজমিন পরির্দশন করে প্রকল্প কাজ ৩০ ভাগ বাকি রেখেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমুদয় টাকা পরিশোধ করার ঘটনা এবং অসম্পূর্ণ ও নিম্নমানের কাজসহ বিভিন্ন অনিয়মের সন্ধান পায়। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসন চার দফা সুপারিশসহ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

এ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মেইন রাস্তা (হাইওয়ে) থেকে প্রধান ফটক পর্যন্ত হেঁটে বা গাড়িতে আসার মতো রাস্তা হয়নি, আরপি গেটের কোনো কাজ হয়নি, স্টাফ কোয়ার্টারে যাতায়াতের জন্য কাঁচা-পাকা কোনো রাস্তাই করা হয়নি, পেরিমিটার ওয়ালের ভেতরে ও বাইরে কোনো ওয়াকওয়ে তৈরি করা হয়নি, কারাগারের ভেতর এবং বাইরে মাটি ভরাটের কাজ ৫০ ভাগও হয়নি, বাইরে গোডাউন অবকাঠামো ব্যতীত ফ্লোর, দরজার কোনো কাজ হয়নি, কারাগারের ভেতরে এবং বাইরে কোনো অবকাঠামোর সঙ্গে পয়ঃনিষ্কাশন ড্রেন এবং পানির কোনো সংযোগ হয়নি, মাটি ভরাট না হওয়ার কারণে সেপ্টিক ট্যাংকের সঙ্গে কোনো লাইন সংযোগ ইত্যাদির কাজ হয়নি, অফিসের আসবাবপত্র, বাথরুম, পানি, বিদ্যুৎ, দরজা-জানালা, ভেতর-বাইরে এবং রান্নাঘরে গ্যাস সংযোগ ইত্যাদির কাজ হয়নি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টারের বাথরুম, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি কাজ হয়নি, ৩টি ওয়াচ টাওয়ারের মধ্যে একটির কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। বাকিগুলো শুরু হয়নি, উৎপাদন শাখার কাজ চলছে, বন্দি ব্যারাক এলাকার ডে লেট্রিনের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে, হাজতি ওয়ার্ডের পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ রাস্তা এবং মাটি ভরাটের কাজ হয়নি, কয়েদি ওয়ার্ডের পয়ঃনিষ্কাশন সংযোগ, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ রাস্তা এবং মাটি ভরাটের কাজ হয়নি, রান্নাঘরে পানি রাখার হাউস ছোট, চুলা বসানো হয়নি। তৎকালিন কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রিজন) মো. তৌহিদুল ইসলামও কিশোরগঞ্জে এসে নির্মাণাধীন কারাগার পরিদর্শন করে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অভিযোগ রয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী কাজ শেষ না হওয়ার পরও কমিশনের বিনিময়ে বিল পরিশোধ করেন। এঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

এছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী আজমুল হকের বিরুদ্ধে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে গ্যাসলাইন দেয়ার টেন্ডারের নামে ‘ভুয়া’ ঠিকাদার নিয়োগ দেখানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। যেই ঠিকাদারের প্রতিষ্ঠানের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে ভুয়া ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছিল, সেই ঠিকাদার এই কাজের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তার প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে যাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে, তাদেরও তিনি চেনেন না বলে কিশোরগঞ্জ জেলা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজমুল হক এবং জেলা তিতাস গ্যাস কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোক্তার আহমদকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপকও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীকে পাল্টা চিঠি দিয়ে তিতাসের অনুমোদিত ঠিকাদার নিয়োগ দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, শহরতলির যশোদল এলাকায় ৫৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মিত হয় গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে। ফলে গ্যাসলাইন বসানোর ঠিকাদারও নিয়োগ দেবার দায়িত্ব ছিল গণপূর্ত বিভাগের।

২০১৮ সালের ২ নভেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সৈয়দ নজরুল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের গ্যাস সংযোগ প্রদানের লক্ষ্যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পাইপলাইন ডিজাইন ডিপার্টমেন্ট (পিডিডি) থেকে উপ-মহাব্যবস্থাপকসহ (ডিজিএম) চরজন কর্মকর্তার ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরের স্বাক্ষরে এক কোটি ২৩ লাখ ১০ হাজার ৩৬৪ টাকা ১৬ পয়সার প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। কিন্তু এর আগেই কিশোরগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজমুল হক ২০১৮ সালের ২৫ জুন তারিখের স্বাক্ষরে গ্যাস কোম্পানির কিশোরগঞ্জ অফিসের ব্যবস্থাপক মোক্তার আহমদকে স্মারক নম্বরসহ লেখা এক চিঠিতে জানান, গ্যাস সংযোগের নিমিত্তে ময়মনসিংহ শহরের ৭১/এ, এ.বি গুহ রোডের ‘মেসার্স আশরাফুল-এমআরকে-এমএসই (জেভি)’ নামে প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়েছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হাজী মো. মোবারক হোসেন আঞ্জু অত্র দফতরের তত্ত্বাবধানে গ্যাস সংযোগের কাজটি সম্পন্ন করবেন। চিঠিতে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও জেলা তিতাস গ্যাস ব্যবস্থাপককে বলা হয়েছে। এদিকে তিতাস গ্যাসের কয়েকজন ঠিকাদার এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, কখনই প্রক্কলন তৈরির আগে ঠিকাদার নিয়োগ হতে পারে না। প্রক্কলনই হলো না, ঠিকাদার কি করে বুঝবেন কত টাকার কাজ, গ্যাস লাইনের মালামালের কি দাম? অথচ এক্ষেত্রে প্রাক্কলন হয়েছে ৪ সেপ্টেম্বর, আর ঠিকাদার নিয়োগের চিঠি এসে গেছে ২৫ জুন! ‘ভুয়া’ ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে কোন কাজ না করেই গোপনে বিপুল অঙ্কের টাকা উত্তোলন করে আত্মসাত করা হয়েছে বলেও কেউ কেউ ধারণা করছেন। অপরদিকে মেসার্স আশরাফুল এন্টারপ্রাইজের মালিক আশরাফুল আলম গত ৯ অক্টোবরের স্বাক্ষরে কিশোরগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজমুল হককে লেখা একটি চিঠিতে প্রশ্ন করে লিখেছেন, তার প্রতিষ্ঠানকে উল্লেখিত কাজের ঠিকাদার নিয়োগের বিষয়টি গত ১ অক্টোবর তিতাস গ্যাস কোম্পানীর ময়মসিংহের ডিজিএম এবং কিশোরগঞ্জের ব্যবস্থাপকের কাছ থেকে মৌখিকভাবে জেনেছেন। অথচ তিনি এ বিষয়ে কোন চিঠি পাননি।

নির্বাহী প্রকৌশলী আজমুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও সম্প্রতি তার বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর প্রত্যাহারের পরই তিনি গণপূর্ত ঢাকার গুরত্বপুর্ন মেডিকেল ডিভিশনে পদায়ন পাওয়ার কর্মকর্তা কর্মচারিদের মধ্যে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। প্রধান প্রকৌশলীকে তিনি কিভাবে ম্যানেজ করলেন তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। কারন মেডিকেল ডিভিশনে বর্তমানে দায়িত্বপালনকারি নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম থেকে এই ডিভিশনে বদলী হয়ে এসেছেন মাত্র এক বছর। তিন বছরের আগে বদলী করায় নানা প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া তিনি এর আগে মেডিকেল উপ-বিভাগে এসডিই হিসেবেও ৩ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।

শুধু তৌহিদূল ইসলাম নয়, বদলী আদেশ হওয়া ইডেন গনপুর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়সাল হালিমকে তার কর্মস্থলে মাত্র দুই বছর হওয়ার আগেই রাজশাহীতে বদলী করা হয়েছিল। তবে বদলী নিয়ে সমালোচনা উঠায় পরের দিন ১৮ আগস্ট ফয়সাল হালিম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী ( সংস্থাপন) আহমেদ আবদুল্লাহ নুরের বদলী আদেশ স্থগিত করা হয়।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন