বাড়ছে অনলাইন জুয়ার আসক্তি, বিপথে কিশোর-তরুণরা

1690
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

মিশু রাজধানীর মিরপুরের একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ১৪ বছরে পা দেওয়া এই কিশোর যখন ব্যস্ত থাকার কথা পড়াশোনা নিয়ে, সে সময়ে তার ব্যস্ত সময় কাটছে মোবাইলের স্ক্রিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থেকে। পড়াশোনায় মেধাবী মিশু টানা দেড় বছর নিয়ন্ত্রণহীন মোবাইল ব্যবহারে অনলাইন জুয়ার নেশায় পড়েছে।
করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরবন্দি মিশু তার মায়ের অ্যান্ড্রোয়েড ফোনে প্রায়ই গেম খেলতো। একমাত্র ছেলে হওয়ায় তেমন বাধা দিতেন না মা-বাবা। প্রথম দিকে বিষয়টি ততোটা গুরুত্ব না দিলেও এক সময় মিশু’র মোবাইল আসক্তিতে তাঁদের ভুল ভাঙে। শুধু মোবাইল আসক্তিই নয়, এখন অনেকটা জুয়াড়িতে পরিণত হয়েছে ১৪ বছরের মিশু। এতে মিশু’র বাবা-মা তাঁদের একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন চরম উদ্বিগ্ন।

মিশুর মা স্মৃতি জানান, ক্লাস এইটের পরীক্ষার আগেই করোনার মহামারি শুরু হয় দেশে। এসময় ছেলে যাতে ঘরের বাইরে না যায় সেজন্য আমার মোবাইল নিয়ে সে বিভিন্ন গেমস খেললেও তাকে বাধা দিতাম না। ভাবতাম করোনার বিপদের চেয়ে মোবাইলে গেমস খেলা ভালো। কিন্তু এই গেমস যখন তাকে জুয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে তখনি আসলে আমাদের ভুল ভাঙে। যদিও ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

এ প্রতিবেদকের সংগে আলাপকালে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কিভাবে কিশোররা তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে তার অন্যতম প্রমাণ আমার ছেলে। আমি যখন দেখলাম করোনার মধ্যে ছেলেটা সারাদিন বাসায় থাকতে থাকতে কেমন যেন এক একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনাও করতে চাইছে না। পড়ার কথা বললেই বই-খাতা ছুঁড়ে মারে। তখন তাকে একটু নিয়ন্ত্রণে রাখতে মোবাইলে গেমস খেলতে দিতাম। এতে মনে হতো সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। তাই আমরা ভাবলাম একটু আধটু গেমস খেললে কী এমন ক্ষতি হবে, খেলুক। কিন্তু ওই গেমসগুলো খেলতে গিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন আসতো। কখনও কখনও সে সেগুলোর দুয়েকটাতে ক্লিক করতো। এটা থেকেই সে কোনো এক সময় অনলাইনে জুয়া খেলার লিংক পায়।

এই মা বলেন, এভাবে প্রায় ছয়মাস কেটে যাওয়ার পর আমরা টের পেলাম- গতমাসে সে তার বাবার কাছে ১০ হাজার টাকা চেয়েছিলো, তার কোনো এক বন্ধুকে ধার দেওয়ার জন্য। কিন্তু করোনার কারণে তার বাবা যে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে জব করে সেখানে বেতন কমে গেছে। এমতাবস্থায় সংসার চালানো যেখানে দায়, সেখানে কোনো এক বন্ধুকে ১০ হাজার টাকা ধার দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু ছেলে কোনোভাবেই মানতে রাজি না। এটা নিয়ে তার বাবার সংগে সে রাগারাগি করে। পরে তার বাবা খোঁজ নিয়ে দেখে সে মোবাইলে জুয়ার আসক্তিতে পড়েছে।

তিনি বলেন, আমাদেরকে না জানিয়ে সে কোনো এক ফেসবুক বন্ধুর মাধ্যমে ১ হাজার টাকা দিয়ে ১০ ডলার কিনেছিলো। ওই টাকা দিয়ে সে বিদেশি কোনো এক ফুটবল ম্যাচের জয় নিয়ে বাজি ধরেছিলো। এতে সে ২০ ডলার পেয়েছিলো। এভাবেই কখনও সে জিততো, আবার কখনও হেরে যেতো। গত দেড় বছর ধরে সে এই খেলা খেলতো। কিন্তু আমরা টের পাইনি। কিন্তু গত মাসে সে যাদের মাধ্যমে জুয়া খেলা শুরু করেছে তারা তাকে জানিয়েছে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকার যদি বাজি ধরে তবে সে তাদের মেম্বার হতে পারবে। মেম্বার হলে ডলার শেষ হয়ে গেলেও সে ক্রেডিট (লোন) নিয়ে খেলতে পারবে। এজন্যই সে টাকার জন্য পাগল গেছিলো। তবে শেষ পর্যন্ত তার বাবা বিষয়টি জানতে পেরে মোবাইল কেড়ে নিয়েছে এবং এখন মানসিক ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছি। এখন মিশু জুয়া খেলে না। কিন্তু আমরা তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে, কিভাবে ছেলেকে এই পথ থেকে ফেরাবো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, রেবটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম, পেডি পাওয়ার ডটকম, বাজীগর ডটকম, প্লেবেট৩৬৫ ডটকম, লগ১০ ডট লাইভ, ৯ক্রিকেট, বিডিটি১০ডটকম, বেটবি২ডটকম, বেটস্কোর২৪ ডটকম, টাকা৬৫ ডটকম, উইনস৬৫ ডটকম, জয়টি২০ ডটকম, ভিক্টর২৬ ডটকম, ৬ক্রিকেট ডটকম, ইন্ডিতা৯৬ ডটকম, লাক বেট বিডি ডটকম, ওপেন বেট ডট লাইভ, এলবিএস২৪ ডটকম, বেট উইন ৯৬ ডটকম, স্পোর্টস ৩৩৩ ডটকম ও বেট বাটার ফ্লাই ডটকম সহ এমন অর্ধশতাধিক জুয়ার অনলাইন সাইট রয়েছে। এসব বেটিং সাইটের মাধ্যমে শুধু শিক্ষার্থী মিশু-ই নয়, সর্বস্ব হারাচ্ছেন লাখো তরুণ। সেই সংগে অল্প টাকায় অধিক লাভের নেশায় পড়ে বিপথগামী হচ্ছেন তারা।

তথ্য বলছে, এসব বেটিং সাইট বিটিআরসি’র নজরে এলে বন্ধ করা হয়। কিন্তু অত্যন্ত চালাক-চতুর হওয়ায় এসব সাইট পরিচালনাকারীরা বিদেশে বসে বন্ধ হওয়া সাইটগুলো রাতারাতি ভিন্ন ডোমেইনে হুবহু চালু করে পরিচালনা করছে। আবার কেউ কেউ ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করেই এসব সাইটে খেলছে জুয়া। এছাড়া কিছু কিছু সাইটের অ্যাপসও রয়েছে। যা সহজে বন্ধ করা যায় না। মূলতঃ এসব সাইটে সরাসরি কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। এজন্য জুয়াড়িদের সহযোগিতায় রয়েছে ফেসবুক গ্রুপ। সেই সংগে ইউটিউবেও দেখানো হয় জুয়া খেলার টিউটিরিয়াল। এসব গ্রুপ ও টিউটেরিয়াল দেখে বাজি খেলায় উদ্বুদ্ধ হয় তরুণরা।

গত পাঁচ বছরের বেশী সময় ধরে জুয়া খেলছেন এমন একজন তরুণ নাইমুল রশিদ। রাজধানীর একটি সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক পড়ুয়া এই তরুণ বলেন, ২০১৬ সালের জুলাইয়ের দিকে ফেসবুকে ‘বেট ৩৬৫’ নামে একটি গ্রুপ পাই। এখানে জয়েন করার পর প্রতিনিয়ত আপডেট পোস্ট দেখতাম। পোস্টগুলোতে যারা বাজি খেলতো তাদের জয়ের নানান লেখা থাকতে। কেউ লিখতো ১০ ডলার বাজি ধরে ৩০ ডলার জিতলাম। কেউ লিখতো আজকের ম্যাচে ৫ ডলার বাজি ধরে ১৫ ডলার পেলাম। এসব দেখে এক সময় আমার নিজের ভেতর ইচ্ছা কাজ করতো। ভাবতাম আমিও যদি খেলতাম লাভবান হতাম। তাই এক সময় যারা পোস্ট দিতো তাদের কমেন্টে আমিও খেলার আগ্রহ দেখিয়ে লিখতাম- আমাকে যেন একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। একদিন এক ভাই ফোন দিলেন হোয়ায়টস অ্যাপে। তিনি অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে বললেন, আমি যদি বিকাশে ১ হাজার ২০ টাকা পাঠাই তাহলে তিনি ১০ ডলার আমার অ্যাকাউন্টে পাঠাবেন। তার কথায় আমি রাজি হয়ে টাকা পাঠালাম। ১০ মিনিটের মধ্যেই দেখি ডলার এসে গেছে আমার অ্যাকাউন্টে। এরপর থেকেই খেলা চলছে আমার।

তিনি বলেন, এই যে খেলা শুরু হলো এরপর থেকে এখনও খেলি। তবে বাস্তবতা হলো লাভ তো দূরের কথা- হিসাব করলে অন্তত এক লাখ টাকার বেশি হারিয়েছি এই খেলায়। তবুও ছাড়তে পারি না। কারণ অনেক বছর ধরে এটাতে যুক্ত থাকায় এক ধরনের নেশা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অনেক লাভও হয়। আবার মাঝে মাঝে একটানে সব চলে যায়। কিন্তু লাভের চেয়ে লসটা যে বেশি এটা নেশার কারণে ফিল হয় না। আমার এখন নেশা এমন যে, পকেটে টাকা থাকলেই খেলি। তবে এটা আসলে জীবনে কিছুই দেয় না। বরং সময়-অর্থ দুটোই কেড়ে নেয়। যেমন সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটা জানার পরও মানুষ সিগারেট খায়, এই বেটিং খেলাও তেমন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে বেটিং খেলায় উব্ধুব্ধ করতে নানান চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এমনকি- শর্টফিল্ম বানিয়ে ভিডিওর ভেতরে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন চালানো হয়। বিশেষ করে ইউটিউবে বিভিন্ন জনপ্রিয় গানের রিমেক ভিডিওতে বেটিং সাইটের চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এসব ভিডিও কয়েক কোটি ভিউ হচ্ছে। যার মাধ্যমে তরুণরা উদ্বুদ্ধ হয়।

অপরাধ বিশেজ্ঞরা বলছেন, একটু একটু করে বেটিং খেলা থেকেই এক সময় নেশা আসক্ত হয়ে পড়ে তরুণরা। একটা সময় বড় ধরণের জুয়াড়িতে পরিণত হয় তারা। এতে টাকার সংকটে এক সময় পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। ফলে এটি একদিকে যেমন পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এতে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।

অনলাইন জুয়া খেলা বন্ধে রাষ্ট্রীয় নজরদারির তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, এই ধরনের অপরাধ (জুয়া খেলা) নিয়ন্ত্রণে পারিবারিকভাবে যেমন সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকেও নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে জুয়া খেলা আইনের পরিবর্তন এবং যেসব সাইটে জুয়া খেলা হয় সেগুলোর তালিকা তৈরি করে বন্ধ করা ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-কশিনার শরীফুল ইসলাম বলেন, অনলাইন জুয়া নিয়ে বিভিন্ন চক্রকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত আরও অনেক চক্রের সৃষ্টি হচ্ছে। যেগুলোর বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। তবে এটার জন্য পারিবারিক সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। আমার সন্তান কোথায় কী করছে এই খোঁজ না নিলে সন্তান জুয়া খেলার মতো নেশায় পড়বে। তাই এটি মোকাবেলায় আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পারিবারিক সচেতনতা খুব জরুরি।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন