জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে চলছে পরিবহণ ধর্মঘট

1155
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে সারা দেশে পরিবহণ ধর্মঘট পালন করছেন মালিক-শ্রমিকেরা। এর ফলে যাত্রীরা জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে যেমন রাজধানীতে আসতে পারছেন না, তেমনি রাজধানী থেকেও তাঁরা ঢাকার বাইরে যেতে পারছেন না। এ ছাড়া ধর্মঘটে আটকে পড়ে চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষা দিতে রাজধানীতে আসতে পারেননি পরীক্ষার্থীরা। প্রতিবাদে সাভারে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তাঁরা। শুধু যাত্রী ও শিক্ষার্থীরা নন, ধর্মঘটের কারণে পণ্য পরিবহণও বন্ধ রয়েছে।

এদিকে, রাজধানী ঢাকায় আজ সকাল থেকে যাত্রীবাহী বাস খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তবে, বিভিন্ন এলাকায় বিআরটিসি’র বাস চলতে দেখা গেছে। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় গন্তব্যে পৌঁছাতে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, লেগুনায় করে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন তাঁরা। তবে শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় অফিসগামী যাত্রীদের খুব একটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি।

রাজধানীর বাইরে নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ

সাভার : পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ‘ধর্মঘটে’ আটকে পড়ার প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের স্নাতক শ্রেণির ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থীরা।

আজ শুক্রবার পরীক্ষার্থীদের আকস্মিক এ কর্মসূচিতে যোগ দেন রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণেচ্ছুরা। পরে একে একে তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা জানান সড়ক ব্যবহারকারী জনসাধারণও।

যানবাহন সংকটে আটকে পড়া কলেজ ভর্তিচ্ছু এবং নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণেচ্ছুরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে একপর্যায়ে নিজেরাই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে অবরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় তাঁরা প্রবেশপত্র হাতে নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

এতে মহাসড়কে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায় এবং সড়কের দুপাশে আটকা পড়ে অসংখ্য যানবাহন।

মিরপুর বাঙলা কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী আবরার হোসেন জানান, আজ ভোরে তিনি ভর্তি পরীক্ষার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসে কোনো গাড়ি পাননি। কোনো উপায় না পেয়ে তিনি রিকশায় করে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখতে পান তাঁর মতো অনেকেই মহাসড়কে যানবাহনের অপেক্ষায়।

একপর্যায়ে দীর্ঘ সময় অবস্থানের পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে আবরার হোসেনের মতো ভর্তিচ্ছুরা মহাসড়ক অবরোধ শুরু করেন। পরে তাঁদের সঙ্গে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ছাড়াও সাধারণ যানবাহনে চলাচলকারীরা যোগ দেন।

এদিকে, আকস্মিক এ কর্মসূচিতে ব্যক্তিগত যানবাহনে করে ঢাকা যাওয়ার পথে শিমুলতলা আটকে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী তাসনিয়া রহমান।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তাসনিয়া রহমান জানান, তাঁর ব্যক্তিগত যানবাহন থাকলেও তিনি শিক্ষার্থীদের এ কর্মসূচিকে সমর্থন করেন। তাঁর ভাষায়, ব্যক্তিগত যানবাহনে করে কেউ পরীক্ষার হলে যেতে পারবে, আর পরিবহণ ধর্মঘটে কেউ আটকে থাকবে—এটা হতে পারে না।

যানবাহন সংকটের পাশাপাশি অবরোধে আটকে পড়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে ছোট ভাইকে নিয়ে মারাত্মক ভোগান্তির কবলে পড়েন রফসান আহমেদ নামের একজন ব্যবসায়ী।

রফসান আহমেদ বলেন, ‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার যেমন হুট করে তেলের দাম বাড়িয়েছে, তেমনি পরিবহণ শ্রমিক-মালিকেরাও যাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে ধর্মঘট ডেকে বসেছেন।’

বাবুল মিয়া নামের একজন পরিবহণ মালিক জানান, করোনার ধাক্কায় গত প্রায় দুই বছরে তাঁরা নাজুক অবস্থায় পড়েছেন। তেলের দাম বাড়ায় একটি বাস থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ২০০ টাকা আয় হওয়ার কথা থাকলেও, এখন আয় কমে নেমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪০০ টাকায়।

বাবুল মিয়া বলেন, ব্যাংকের কিস্তি, সরকারি ট্যাক্স-টোকেন, রাস্তার চাঁদা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাড়িভাড়া—সবকিছু মিলিয়ে জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সে কারণে যৌক্তিকভাবেই তাঁরা পরিবহণ ধর্মঘট ডেকেছেন। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সরকার ভাড়া বিন্যাস করলে এমন সংকট তৈরি হতো না। এর জন্য সরকারকেই দায়ী করেন তিনি।

এদিকে, আগামী ৭ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। এক হাজার ৯০০ আসনের বিপরীতে আবেদন করেছেন তিন লাখ আট হাজার ৬০৬ জন। দূরদূরান্ত থেকে আসা ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অনেকেই পথে নেমে ভোগান্তির মুখে পড়েছেন।

সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাইনুল ইসলাম জানান, সাভারে পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ‘ধর্মঘটে’ আটকে পড়ার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ছাড়াও সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণেচ্ছুরা আটকে পড়েছেন। ধর্মঘটের প্রতিবাদে তাঁরা নিজেরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করায় সাধারণত ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহারকারীরা রাস্তায় আটকে পড়েছেন।

ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। এমনিতেই সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের রয়েছে, তার ওপর তাদের এ কর্মসূচি দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’

রাজশাহী : আজ সকাল থেকে রাজশাহীর সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে সড়ক পরিবহণ মালিক-শ্রমিকেরা। তাঁদের এই কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করেছে রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নও। সকাল থেকে রাজশাহীর কোনো রুটেই বাস চলাচল করছে না। সেইসঙ্গে দূরপাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ রয়েছে।

হঠাৎ করে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জনভোগান্তি বেড়েছে। অনেকেই বাস কাউন্টারে এসে ফিরে যাচ্ছেন। ছুটিতে আসা চাকরিজীবীরা রাজশাহী থেকে যেতে পারছেন না কর্মস্থলে। জনভোগান্তি লাঘবে জ্বালানি তেলের দাম বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

জনভোগান্তির বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক সাফকাত মঞ্জুর বিপ্লব জানান, ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বেড়ে যাওয়ায় বাস চালাতে গেলে তাদের ভর্তুকি দিতে হবে। তবে তিনি করোনার কারণে সব সেক্টরের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করে পরিবহণের ভাড়া না বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর পরামর্শ দেন।

খুলনা : আজ সকাল থেকে খুলনা বিভাগে বাস, ট্রাকসহ সব গণপরিবহণে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চলছে। সকাল থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। ফলে ধর্মঘটে যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের এসে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

এ ছাড়া বাস, ট্রাক, লরি, মাহিন্দ্রা, সিএনজিসহ জ্বালানি তেল ব্যবহার করা কোনো যানবাহন চলাচল করছে না। শুধু ইজিবাইক, প্রাইভেটকার ও রিকশার চলাচল লক্ষ্য করা গেছে।

এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খুলনা সড়ক পরিবহণ মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি আব্দুল গাফফার বিশ্বাস এই অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ঘোষণা করেন।

কুমিল্লা : আজ সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কুমিল্লা থেকে তিন টার্মিনালের ২৬টি রুটে দুই হাজার যাত্রীবাহী বাসসহ পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। জেলা সড়ক পরিবহণ মালিক গ্রুপ গতকাল বাসসহ পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কুমিল্লা জেলা সড়ক পরিবহণের মালিক গ্রুপের সভাপতি অধ্যক্ষ কবির আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তেলের দাম বৃদ্ধিতে পরিবহণ মালিকেরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।’

জয়পুরহাট : আজ ভোর ৬টা থেকে জয়পুরহাট থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানের দূরপাল্লা ও আন্তঃজেলা রুটের সব ধরনের ইঞ্জিনচালিত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে জয়পুরহাট জেলা বাস টার্মিনাল থেকে কোনো যাত্রীবাহী যানবাহন ছেড়ে যায়নি। এ অবস্থায় আজ সকাল থেকে সারা দেশের সঙ্গে জয়পুরহাটের সড়ক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে।

জয়পুরহাট জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা রফিকুল ইসলাম রফিক জানান, কোনো গণশুনানি করা কিংবা পরিবহণ মালিক-শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এ পরিবহণ ধর্মঘট পালন করা হচ্ছে।’

শেয়ার করতে ক্লিক করুন