হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রে কাঁপছে বিশ্ব, নিরাপত্তায় হুমকি

960
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে গত ১৮ মার্চ ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত দেশটির সেনাবাহিনীর একটি অস্ত্র ভাণ্ডার উড়িয়ে দেয় রাশিয়া। ভীতিকর শোনালেও, ওই হাইপারসনিক মিসাইলে রাশিয়ানরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল তা বিশেষভাবে উন্নত নয় বলে দাবি অনেকের। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাশিয়া, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক যেসব হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে তা জাতীয় ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমত, নিজের গতিপথ ধরে চলার সময়েই বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। কারণ, উৎক্ষেপণের পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর গতিপথ পরিবর্তিত হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, নতুন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ধীরগতির সাবসনিক মিসাইলের তুলনায় অনেক বেশি উচ্চতায় এবং আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় অনেক কম উচ্চতায় ওড়ে। ফলে মাঝামাঝি উচ্চতায় ওড়া এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করা কঠিন। এমনকি, এই মিসাইল শনাক্ত করার প্রযুক্তি নেই রাশিয়া, চীন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছেও।

অস্থিতিশীল প্রভাব: রাশিয়ার দাবি, তাদের কাছে এমন কিছু হাইপারসনিক অস্ত্র রয়েছে যা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। সত্য হোক বা মিথ্যা, মস্কোর এমন দাবিই বড় উদ্বেগের কারণ। আর রাশিয়ার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক হামলা হিসেবে বিবেচনায় নিলে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, সেক্ষেত্রে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র খালাস করে মস্কোকে জবাব দিতে চাইবে ওয়াশিংটন।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আধুনিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যে অস্থিতিশীল প্রভাব সৃষ্টি করছে, সেটিই সম্ভবত বৈশ্বিক নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় হুমকির কারণ। আবার অনেকের বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের উচিত দ্রুত তাদের হাইপারসনিক অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা। যাতে এ ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলোকে সহজে আলোচনার টেবিলে আনা যায়।

হাইপারসনিক কী?

একটি যানকে হাইপারসনিক হিসেবে বর্ণনা করার অর্থ হলো এটি শব্দের চেয়েও দ্রুতগতির। যা সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রতি ঘণ্টায় ৭৬১ মাইল (১২২৫ কিলোমিটার) এবং ৩৫ হাজার ফুট (১০,৬৬৮ মিটার) উচ্চতায় প্রতি ঘণ্টায় ৬৬৩ মাইল (১০৬৭ কিলোমিটার) গতিতে ছুটতে সক্ষম।

যাত্রীবাহী জেটগুলো যেখানে প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ মাইল (৯৬৬ কিলোমিটার) গতিবেগে চলে, সেখানে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতি ঘণ্টায় ছুটে চলে সাড়ে তিন হাজার মাইল বা ৫ হাজার ৬৩৩ কিলোমিটার গতিবেগে।

বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রাগারে থাকা সমস্ত আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই হাইপারসনিক। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ছুটতে পারে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫ হাজার মাইল (২৪,১৪০ কিলোমিটার) বা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪ মাইল (৬.৪ কিলোমিটার) গতিবেগে।

তিন ধরনের হাইপারসনিক মিসাইল: আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নয়, এমন হাইপারসনিক অস্ত্র রয়েছে তিন ধরনের। সেগুলো হলো, অ্যারো-ব্যালিস্টিক, গ্লাইড যান এবং ক্রুজ মিসাইল।

এর মধ্যে হাইপারসনিক অ্যারো-ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ফেলা হয় বিমান থেকে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনী ‘কিনঝাল’ নামে যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল, সেটিও অ্যারো-ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছিল। ১৯৮০ সাল থেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

হাইপারসনিক গ্লাইড যানের মধ্যে রয়েছে চীনের ডংফেং-১৭, রাশিয়ার অ্যাভানগার্ড এবং মার্কিন নৌবাহিনীর কনভেনশনাল প্রম্পট স্ট্রাইক সিস্টেম। চীনের হাইপারসনিক গ্লাইড যান প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির চেয়েও উন্নত জানিয়ে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন খোদ মার্কিন কর্মকর্তারাই।

ক্রুজ মিসাইলকে একটি রকেটের মাধ্যমে হাইপারসনিক গতিতে উন্নীত করা হয় এবং তারপর সেই গতি বজায় রাখতে ব্যবহার করা হয় ‘স্ক্র্যামজেট’ নামক একটি ইঞ্জিন। হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য হাইপারসনিক গ্লাইড যানের চেয়ে ছোট লঞ্চ রকেটের প্রয়োজন হয়। ফলে কম খরচে বেশি জায়গা থেকে উৎক্ষেপণ করা যায় ক্রুজ মিসাইল।

ঠেকানো কঠিন: হাইপারসনিক মিসাইলের বড় শক্তি গতি। এর গতিরোধের মতো কোনো প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশের হাতেই নেই। আর এটিই দেশগুলোর কাছে আধুনিক হাইপারসনিক অস্ত্র বিকাশের প্রাথমিক কারণ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হাইপারসনিক অস্ত্র এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার সকল কার্যকলাপের পাশাপাশি জাতীয় ও বৈশ্বিক নিরাপত্তায় এ ধরনের অস্ত্রের হুমকির মূল্যায়নও জরুরি। হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র সাধারণত দূরের লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়, যা অনেক সময় বড় সংঘর্ষের কারণ।

তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় বেশি পরিমাণে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্প্রতিক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারে এটি স্পষ্ট যে, এ ধরনের অস্ত্র অগত্যা কোনো ‘রূপালী বুলেট’ নয় যা কোনো সংঘাতের অবসান ঘটায়।

এশিয়া টাইমস অবলম্বনে

শেয়ার করতে ক্লিক করুন