নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নির্ধারিত তারিখে ছাত্রলীগের সম্মেলন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। শনিবার (১২ নভেম্বর) রাবি শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও শুক্রবার রাতে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা আসছেন না বলে জানানো হয়। তবে সম্মেলন স্থগিতের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে সম্মেলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের একেক জন একেক রকম তথ্য দিয়েছেন।
রাবি শাখা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের মেয়াদের শেষ সময়ে নিজেদের মতো করে নেতৃত্ব চাপিয়ে দিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। রাবি ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তারা ইচ্ছে করলেই সম্মেলন স্থগিত করার ঘোষণা দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তারা নির্ধারিত দিনে সম্মেলন না করে প্রেস রিলিজ দিয়ে কমিটি ঘোষণা করার পরিকল্পনা করছেন, যা এই ক্যাম্পাসে অতীতে কখনোই হয়নি। এভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো দায়সারা গোছের কমিটি চাপিয়ে দিলে সংগঠনের অস্তিত্বই বিপণ্ন হতে পারে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলনের দায়িত্ব প্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন সহ-সম্পাদক আফি আজাদ বান্টি জানান, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করায় তারা সেটা নিয়েই ব্যস্ত। সে কারণে এখন রাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘যেহেতু সিভি জমা নিয়েছি, প্রেস কমিটি দেওয়া হবে।’ বিষয়টি গঠনতান্ত্রিকভাবে বৈধ কি না এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
অন্যদিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত আরেক নেতা মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মেহেদি হাসান তাপস বলেন, ‘আমরা সম্মেলনে কেউ যেতে পারবো না। তাই সম্মেলনটা হচ্ছে না। কিন্তু অফিসিয়ালি আমরা একে এখনও স্থগিতও বলছি না।’ তাহলে কমিটি কীভাবে হবে- জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
গত ২৩ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে রাবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির জন্য জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। প্রায় সপ্তাহ না যেতেই আরেক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১২ নভেম্বর রাবি শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় কমিটি। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দেওয়ার শেষ সময়। ৯৪ জন প্রার্থী জীবনবৃত্তান্ত জমা দেন। এর আগেই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তখনও এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেনি সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি। আবার এর মধ্যে সংগঠনের এক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে কমিটিতে পদ দেয়ার অভিযো্গ ওঠে। পরে ভাইরাল হয় পদ দিতে টাকা চাওয়ার ফোনালাপ। এই পরিস্থিতিতে রাবি ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের বেশিরভাগই সুষ্ঠুভাবে কমিটি গঠন হবে কি না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন।
রাবি ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের অভিযোগ, বিতর্কিত কয়েকজন প্রার্থীকে নেতা হিসেবে চাপিয়ে দিতেই কেন্দ্রীয় কমিটির এই কৌশল। এদের মধ্যে অন্যতম বর্তমান কমিটির সহসভাপতি কাজী আমিনুল হক লিংকন। এই প্রার্থী ২০১৭ সালের ২৭ জুন কুষ্টিয়া সদরের হাউজিং ‘সি’ ব্লকের বাসিন্দা তেল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন খোকনের মেয়ে রিফা তিন্নিকে বিয়ে করেছেন। কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আতিকুর রহমান অনিকের আপন খালাতো বোন তিনি। আয়ান নামে একটি ছেলে সন্তানও আছে লিংকন-তিন্নি দম্পতির। আরেক প্রার্থী উপ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক ও রাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ-হিল-গালিব বিভাগ থেকে ড্রপআউট। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য দেওয়া জীবনবৃত্তান্তে তিনি এসএসসি ও এইচএসসির সেশন উল্লেখ করেন। আরেক প্রার্থী মেহেদী হাসান মিশু ২০১৬ সালে হওয়া রাবি ছাত্রলীগের ২৫ তম সম্মেলনে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে সিট বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তিনি ড্রপআউট হন। আরেক প্রার্থী সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক আহমেদ তন্ময়। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক সরবরাহে জড়িত তালিকায় তার নাম আসে। এছাড়া, চলতি শিক্ষাবর্ষে রাবি’র ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি জালিয়াতির ঘটনায়ও তার নাম আসে। যার প্রেক্ষিতে রাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সম্প্রতি সম্মেলনে সিভি জমা দেওয়ার একদিন আগে রহস্যময়ভাবে তন্ময়ের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফারসি বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী এনায়েত হক রাজুর মাস্টার্স শেষ হলেও শীর্ষ পদ পেতে চালাচ্ছেন লবিং-গ্রুপিং। তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাবি শাখা শিবিরের সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম ইমনের সঙ্গেও তার সখ্যের অভিযোগ রয়েছে। এভাবে আরও অন্তত ডজনখানেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক কামরুজ্জামান চঞ্চল বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শুধু রাজশাহীর জন্য না, জাতীয় রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণে এখানে ছাত্রশিবির নানা কৌশলে তাদের তৎপরতা চালিয়েছে অতীতে। এখনও তারা কৌশলে কাজ করছে। এখানে যদি প্রেস রিলিজ দিয়ে ইচ্ছেমতো কমিটি চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সেই নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই কষ্টকর হয়ে যাবে।’ তার মতে, প্রয়োজনে নতুন করে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করে সম্মেলনের মাধ্যমেই গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নিয়ে আসা উচিত।
ছাত্রলীগের আরেক সাবেক নেতা আহসানুল হক পিন্টু মনে করেন, দীর্ঘদিন দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সুবিধাবাদী ও অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বেড়েছে। ফলে নানা প্রলোভনে তারা ‘নিজেদের লোক’ তৈরির চেষ্টা করে থাকে। এতে সংখ্যা বাড়লেও প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী বাড়ছে না।