শ্রম মন্ত্রনালয়ে কেনাকাটা, প্রশিক্ষণ ও গাড়ি মেরামতের নামে হরিলুট

387
শেয়ার করতে ক্লিক করুন
রফিকুল ইসলাম সবুজ:
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের প্রশিক্ষণ শাখা গত ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজনে ২৮ লাখ ৫৬ হাজার ১৩০ টাকা ব্যয় দেখিয়েছে। কিন্তুু বিল ও ভাউচারসহ সশ্লিষ্ট নথি যাচাই করে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজনের জন্য প্রশিক্ষণ সিডিউল ও প্রশিক্ষণার্থীদের কোন হাজিরা শীট পায়নি নীরিক্ষা বিভাগ। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণসামগ্রী ক্রয়ের ক্যাশমেমো বিলের সাথে সংযুক্ত থাকলেও উক্ত প্রশিক্ষণসামগ্রী বিতরণের কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি বলে নীরিক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রনালয়ের সংস্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারিরা জানান, মূলত প্রশিক্ষণ কর্মসুচির আয়োজন না করেই ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে এই অর্থ লোপাট করা হয়েছে। শুধু প্রশিক্ষণ নয়, শ্রম মন্ত্রনালয়ে কেনাকাটা ও গাড়ি মেরামতের নামেও হরিলুটের ঘটনা ধরা পড়েছে নীরিক্ষা প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত অর্থ বছরে ভুয়া ভাউচারে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকা লোপাট হয়েছে। এছাড়া ৬টি গাড়ি মেরামতে বছরে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৮ লাখ টাকা এবং ৭টি গাড়িতে বছরে অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৪ লাখ টাকা। সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেও সদ্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হওয়া শ্রম মন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিব এহসানে এলাহী সার্বক্ষনিক সরকারি একটি গাড়ি (জীপ, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫- ৫১৩৮) ব্যবহার করার পরও গাড়ি রক্ষনাবেক্ষণ খরচ বাবদ প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা করে উত্তোলন করেছেন। মন্ত্রনালয়ের সংস্লিষ্ট সুত্র জানিয়েছে দুই কর্মকর্তার চার প্রতিষ্ঠানের নামে তৈরি হয় এসব ভূয়া বিল ভাউচার। এসব অনিয়ম দূর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে শ্রম মন্ত্রনালয়ের আলোচিত সহকারী সচিব মো. ফয়জুল্যাহ বিশ্বাস এর নেতৃত্বে ৭ কর্মকর্তার একটি সিন্ডিকেট।
নিরীক্ষাকালে মোটরযান মেরামত ও সংরক্ষণ (৩২৫৮১০১) কোডের বিল-ভাউচার পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ঢাকা মেট্রো চ-৫৩-৮৫১৫ নম্বর গাড়ী মেরামত ও সংরক্ষণ বাবদ মোট ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৮১ টাকা, ঢাকা মেট্রো চ-৫৬-১০৮০ গাড়ির জন্য ১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬০ টাকা, ঢাকা মেট্রো চ-৫৩-৮৬৩২ এর জন্য ৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ঢাকা মেট্রো চ-৫৩-৬৩৩২ এর জন্য ৩ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৪ টাকা, ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৯৮৬১ মেরামতের জন্য ৯ লাখ ২৭ হাজার ৯৬৫ টাকা এবং ঢাকা মেট্রো চ-৫৩-৭৫০৩ মেরামতের জন্য  ৬ লাখ ৩,১৯০ টাকাসহ ৬টি গাড়ী মেরামতে ২৮ লাখ ৪৮ হাজার ৩৭০ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আইন, ২০১৫ এর ক্রমিক নং ৯ (ক) অনুযায়ী সরকারি যানবাহন মেরামতের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নিকট অর্পণকৃত ক্ষমতা মোতাবেক বাজেট বরাদ্দ থাকা সাপেক্ষে বছরে ১ টি যানবাহনের ক্ষেত্রে অনুর্ধ্ব ১ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান উক্ত আদেশ ল্ঘংন করে ৬ টি গাড়ীতে ৬ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিবর্তে ২৮ লাখ ৪৮, ৩৭০ টাকা অর্থাৎ ২২ লাখ ৪৮,৩৭০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। যা আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ ২০১৫ এর পরিপন্থি বলে নীরিক্ষা বিভাগ উল্লেখ করেছে।
এছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গত এক বছরে বিধি বহির্ভূতভাবে পেট্রোল ওয়েল লুব্রিকেন্ট বিল প্রদান করায় ৪৩ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩১ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করেছে। মন্ত্রণালয়ের দুটি জীপ গাড়ী (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-৯৮৬১ ও ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-৫১৩৮ এবং ৫ টি মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৭৫০৩, ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৮৬৩২, ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৬৩৩২, ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৮৫১৫ ও ঢাকা মেট্রো-চ-৫৬-১০৮০) এর ড্রাইভার মোঃ রাসেল, মোঃ খলিলুর রহমান, মোঃ আমির হোসেন, মোঃ মজিবুর রহমান, মোঃ আলামিন, মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, মোঃ জামাল হোসেন এর ১২ মাসের পেট্রোল ওয়েল লুব্রিকেন্ট বিল বাবদ ৪১ টি বিলের মাধ্যমে ৪৩ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩১ টাকা পরিশোধ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ট্রিপে কত কিলোমিটার গাড়ী চলেছে তা লগ বইতে লিপিবদ্ধকৃত কিলোমিটারের উপর ভিত্তি করে জ্বালানী হিসাব করতে হবে। কিন্তুু  এটা না করা সত্ত্বেও বিধি বহির্ভূত ভাবে লুব্রিকেন্ট প্রদান করায় ৪৩ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩১ টাকা অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে।
এবিষয়ে শ্রম মন্ত্রনালয়ের সেবা শাখার উপসচিব বিমলেন্দু ভৌমিক গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নিরীক্ষা বিভাগকে জানিয়েছেন প্রশাসনিক প্রয়োজনে গাড়ি মেরামত ও  সংরক্ষণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে লগবহি বিধিমোতাবেক পরিপালন করা হবে। পরবর্তীতে নিরীক্ষা বিভাগকে এবিষয়ে অবহিত করা হবে।
অন্যদিকে গত অর্থ বছরে আর্থিক ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করে সরাসরি নগদ ক্রয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত এক কোটি পঁয়তাল্লিশ লাখ  সাতচল্লিশ হাজার ছয়শত চার টাকা ব্যয় করেছে শ্রম মন্ত্রনালয়। নিরীক্ষা বিভাগ বলছে বিল ভাউচার যাচাইকালে দেখা যায়, কম্পিউটার সামগ্রী, অন্যান্য মণিহারি, আসবাবপত্র, কম্পিউটার মেরামত, অফিস সরঞ্জামাদি ও আসবাবপত্র খাতে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সরাসরি নগদ ক্রয় পদ্ধতিতে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৪৭,৬০৪ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আইন-২০১৫ অনুযায়ী একক ক্ষেত্রে ২৫ হাজার টাকা তবে বছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা সরাসরি নগদ ক্রয় করা যাবে এবং উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি এড়ানোর জন্য মোট ব্যয়ের বিভাজন করা যাবে না। কিন্তু শ্রম মন্ত্রনালয়ের সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ আদেশ না মেনে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে অতিরিক্ত ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪৭,৬০৪ টাকা সরাসরি নগদ ক্রয়ের মাধ্যমে ব্যয় করেছেন, যা আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি। এছাড়া অগ্রীম উত্তোলনকৃত অর্থের সমন্বয় জুন ক্লোজিংয়ের মধ্যে না করায় সমন্বয় বাবদ অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে ৪৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। অগ্রীম বিলের মাধ্যমে প্রশিক্ষন এবং সেমিনার বাবদ এ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
সেবা শাখার মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়া গাড়ি মেরামত, রক্ষনাবেক্ষণ ও জ্বালানী ব্যয় এবং নগদ কেনাকাটার ক্ষেত্রে ২ কোটি ১৪ লাখ টাকার অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। শ্রম মন্ত্রনালয়ের সংস্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সেবা শাখার উপসচিব বিমলেন্দু ভৌমিক ও সহকারী সচিব মোঃ ফয়জুল্লাহ বিশ্বাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান মোড়ল, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোঃ সাইফুল ইসলাম ও খন্দকার হাসনাত কবীর, হিসাব শাখার হিসাবরক্ষক মো. জাকির হোসেন ও আইটি সেলের সহকারি মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম মেহরাব হোসেন সিন্ডিকেট করে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে এই টাকা উত্তোলন করে এর বেশির ভাগই নিজেরা ভাগ করে নিয়েছেন। এছাড়া সাবেক সচিব এর নামে অর্থ হাতিয়ে নিতেন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোঃ শামীম আহমেদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আঃ হাকিম। তারা জানান, সেবা শাখার যাবতীয় কেনাকাটা করা হয় জামান আইটি সলিউশন, অগ্রগামী ট্রেডার্স, স্বপ্নিল ও রোজিনা এন্টার প্রাইজ এর মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোঃ সাইফুল ইসলাম এর বলে সংস্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তারা জানান, ভুয়া বিল ভাউচারের টাকার একটা বড় অংশ পান সহকারি সচিব ও সিন্ডিকেটের প্রধান ফয়জুল্যাহ বিশ্বাস ও হিসাব রক্ষক।
অভিযোগের বিষয়ে সেবা শাখার সহকারি সচিব মো. ফয়জুল্যাহ বিশ্বাস  বলেন, তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উঠেছে তা সঠিক নয়। মন্ত্রনালয়ের একটি পক্ষ তাকে হেয় করার জন্য তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছে। তিনি এ প্রতিবেদককে তার অফিসে গিয়ে দেখা করে সরাসরি কথা বলার আহবান জানান।
প্রসঙ্গত, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দূর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের মূল হোতা সহকারী সচিব মো. ফয়জুল্যাহ বিশ্বাস ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান মোড়লকে সম্প্রতি মন্ত্রনালয়ের সেবা শাখা ও কেন্দ্রীয় তহবিলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অন্যত্র বদলী করা হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সময়ের আলোতে  ‘সিন্ডিকেটের দুর্নীতিতে ডুবছে শ্রম মন্ত্রণালয়’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারিদের মধ্যে ব্যাপক তোলপাড় হয়। সংস্লিষ্টরা জানান, বিষয়টি মন্ত্রনালয়ের নতুন দায়িত্ব নেওয়া সচিবের নজরে আসার পর মঙ্গলবার অভিযুক্ত পরিদর্শন ও পরিসংখ্যান শাখার সহকারি সচিব ফয়জুল্যাহ বিশ্বাস এর সেবা শাখার সংযুক্তি আদেশ বাতিল করা হয়। একই ভাবে সেবা শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) আসাদুজ্জামান মোড়ল এর কেন্দ্রীয় তহবিলের সংযুক্তর আদেশ বাতিল করে তাকে আদালত শাখায় বদলী করা হয়।  সুত্র : সময়ের আলো।
##
শেয়ার করতে ক্লিক করুন