রফিকুল ইসলাম সবুজ:
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরেক দফা জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রশাসনের ২৫, ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের চার শতাধিক কর্মকর্তার (উপসচিব) একটি ফিটলিস্ট প্রস্তুত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ১১ জানুয়ারি থেকে তাদের সাক্ষাৎকার শুরু হয়েছে। এর মধ্যে তালিকায় থাকা ২৫তম ব্যাচের ১১৫ জন উপসচিবের মধ্যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মাত্র ৬৫ জন। বাকি ৫০ জন ডিসি হতে আগ্রহী না হওয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে আসেননি। এ ছাড়া ২৭তম ব্যাচের ১৭০ জনের মধ্যে দুই দফায় ৮০ জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হলেও উপস্থিত ছিলেন ৫০ জন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কয়েক দফায় এ পর্যন্ত ১৯৫ জনকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হলেও উপস্থিত ছিলেন ১১৫ জন। অর্থাৎ, ৪০ শতাংশ কর্মকর্তাই ডিসি হতে আগ্রহী না হওয়ায় সাক্ষাৎকার দিতে আসেননি।
একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদটি উপসচিবদের জন্য অনেকটা লোভনীয়। বিগত সরকারের আমলে ডিসি হওয়ার জন্য মন্ত্রী, এমপি ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের মাধ্যমে তদবির করতেও দেখা গেছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ডিসি হওয়ার জন্য আন্দোলনও করতে দেখা গেছে বঞ্চিত দাবি করা কর্মকর্তাদের। এই নিয়োগ নিয়ে ঘুষ কেলেঙ্কারির মতো অভিযোগও উঠেছিল। তবে সম্প্রতি ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ৪৩ জন সাবেক ডিসিকে ওএসডি ও ২২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৪ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই সিদ্ধান্তের পর নির্বাচনকালীন ডিসি হওয়ার আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে কর্মকর্তাদের। এ কারণে ফিটলিস্টে নাম থাকার পরও অনেকে সাক্ষাৎকার দিতে আসছেন না বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আগামী ডিসেম্বরে দেশে ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন যারা ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাবেন তাদের জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামনে কোন দিকে যায় তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ায় অনেকেই ডিসি হওয়ার ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ডিসি ফিটলিস্টের তালিকায় ১ নম্বরে থাকা জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের (এনআইএলজি) যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন সময়ের আলোকে জানান, তিনি ঢাকার বাইরে যেতে চাচ্ছেন না। এ কারণে তালিকায় নাম থাকার পরও সাক্ষাৎকার দিতে যাননি। তিনি বলেন, সাক্ষাৎকারে অংশ না নেওয়ার সুযোগ রেখেছে ফিটলিস্ট প্রণয়ন কমিটি। নির্বাচন সামনে এ কারণে অনেকেই ডিসি হতে চাইছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার ক্ষেত্রে এমনটা নয়।
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান সময়ের আলোকে বলেন, বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ডিসিদের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করতে দেয় রাষ্ট্র। ডিসি তো ভোটবাক্স ছিনতাই, বিশৃঙ্খলা তৈরি করে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করার সঙ্গে যুক্ত থাকতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিন্তু তার পরও ভোটে দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের বিরুদ্ধে যেভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের চাকরি নেই, ওএসডি করা হয়েছে তাতে অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে তো আতঙ্ক তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ কারণে ডিসি হওয়ার আগ্রহ অনেকের নাও থাকতে পারে।
তার মতে, রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব তো ডিসিদের স্পেশাল বা অতিরিক্ত দায়িত্ব। তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করিয়ে তাদের ওপর আবার নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে অনেকে এখন এই দায়িত্ব নিয়ে আগ্রহী হবে না এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া তারা তো নির্বাচনে একা দায়িত্ব পালন করেননি। ১২ লাখের মতো লোক নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকে। নির্বাচন কমিশন থাকে, সরকারও থাকে। সরকার না চাইলে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না। যে দেশে স্বাধীন সিভিল সার্ভিস নেই, যে দেশে স্বাধীন পুলিশ সার্ভিস ও স্বাধীন জুডিশিয়ারি নেই, স্বাধীন সাংবিধানিক বডিগুলো নেই, সে দেশে মিড লেভেলের কারও কারও ওপর দোষ চাপিয়ে দিলে তো হবে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত শনিবার ডিসি ফিটলিস্টে থাকা ২৭তম ব্যাচের ৩০ কর্মকর্তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছিল। ২৭তম ব্যাচের আরও ৯০ জন এবং ২৮তম ব্যাচের ১৩০ জনসহ মোট ২২০ জনের সাক্ষাৎকার এখনও বাকি রয়েছে। নতুন করে সাক্ষাৎকার কবে নেওয়া হবে তা এখনও ঠিক হয়নি।
কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে ডিসি পদে কর্মরতদের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২৫ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৩ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া খুব শিগগিরই শুরু হতে পারে বিধায় এই ব্যাচের যারা ডিসি আছেন তাদের প্রত্যাহার করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বদলি করা হবে। ফলে সংসদ নির্বাচনের সময় ২৫, ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারাই ডিসি হিসেবে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন।
কর্মকর্তারা জানান, ২৫তম ব্যাচের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে। তারা চাকরিতে যোগ দেন ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট। আর ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দেন ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়া ২৮তম ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দেন ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর।
কর্মকর্তারা জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই তিন ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিসি হিসেবে নির্বাচনি মূল দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের নিয়োগ দিতে শর্ত শিথিল করা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে কাজ না করলেও ডিসি হতে পারবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মচারীদের পদায়ন নীতিমালা-২০২২-এ বলা হয়েছে, ডিসি ফিটলিস্ট প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক, এডিসি, জেলা পরিষদের সচিব, পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ইউএনও উভয় পদে মোট ন্যূনতম দুই বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা পদবঞ্চিত থাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে দুই বছর কাজ করার সুযোগ পাননি। এ জন্য মাঠ প্রশাসনের এসব পদে দুই বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক সময়ের আলোকে বলেন, ডিসি নিয়োগের ফিটলিস্ট চূড়ান্ত করার বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এক ব্যাচ শেষ হবে আবার নতুন ব্যাচ শুরু হবে। এবার ডিসি হতে কর্মকর্তাদের আগ্রহ কম থাকার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের ডিসি করা হবে। এর আগে সরকার পরিবর্তনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দায়িত্ব পালন করা ডিসিদের পরিবর্তনের সময় তালিকা তৈরিতে সময় কম পাওয়া গিয়েছিল। এ কারণে ডিসি নিয়োগ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তাই এবার একটু সময় নিয়ে যাচাই-বাছাই করে বিতর্কহীন তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সুত্র: দৈনিক সময়ের আলো।