দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ও ১৪ সদস্যের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব বিএনপির

115
শেয়ার করতে ক্লিক করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক:

ভবিষ্যতে যাতে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না হতে পারে সেই জন্য আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিদের মধ্যে কমছে কম দুই-তিনজনের মধ্য থেকে নিয়োগের পক্ষে বিএনপি। বিএনপি’র পক্ষ থেকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো এবং ১৪ সদস্যের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালি করতে পৃথক প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। রবিবার জাতীয় সংসদ ভবনের এলজি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে তৃতীয় দফায় সংলাপে এই প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মনির হায়দার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টরে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত যে অধ্যাদেশ জারি করেছে, সেটা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে উদ্যোগটা গ্রহণ করেছ- এটাসহ আমরা বিচার বিভাগ বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। সেটা বাস্তবায়নে আমাদের অঙ্গীকার আছে।
সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছ বিচার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। বিষয়টিতে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আহমেদ বলেন, ওনাদের প্রস্তাব ছিলো আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট যেন পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হন। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রের মধ্যে কিছু অসঙ্গতি আগে দেখা গেছে। সর্বক্ষেত্রে আমরা যদি নির্দিষ্ট করে দি, কোন বিকল্প না থাকলে, ভবিষ্যতে যেহেতু আমরা বিচারবিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে চায়, সেক্ষেত্রে আগের মত কোন বিতর্কিত ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি হন, এটা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না। তিনি বলেন, এখানে একটা অন্তত বিকল্প থাকা উচিত, আপিল বিভাগের সিনিয়র মোস্ট বিচারপতিদের মধ্যে কমছে কম দুই-তিনজন এ অপশনে থাকে৷ সেই জায়গাটা এখনো গৃহীত হয়নি। এখনো আলোচনা চলছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নেসেসিটি মেকস ল। আমাদের কাছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। ডকট্রিন অব নেসেসিটি বিবেচনা রেখেই কিছু অপশন রাখা সুবিধা। না হলে রাষ্ট্র এমন কোন ব্যক্তির হাতে পড়ে যাবে, যা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না। তিনি আরো বলেন, মন্ত্রী পরিষদ প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে পরিচালিত। কিন্তু ওনারা বলেছেন কালেকটিভলি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা কর্তৃক পরিচালিত। তাতে এখানে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকে না। আমরা বলেছ প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাক উচিত।
একজন সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। দলটির প্রস্তাবে বলা আছে, দুইবারের পরে বিরতি দিয়ে আবারো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আছে। তবে রবিবার মূলতবি হওয়া বৈঠেেকর আলোচনায় একজন সর্বোচ্চ তিনবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন এমন কথা হয়। বিষয়টি বিএনপিও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে।
এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিকল্প প্রস্তাবের জন্য অপেক্ষা করেন। আর তারা ফরমালি প্রস্তাবটি আমাদের দেয়নি। তিনি আরো বলেন, একজন ব্যক্তি যাতে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা পদে না থাকেন সেটি নিয়ে আলাপ হয়েছে। এখানে যে মেজরিটি পার্টি সংসদে সংসদীয় দল হয়, সেই পার্টি সিদ্ধান্ত নেয়, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন। এটা জরুরি নয় যে, পার্টির প্রধান প্রধানমন্ত্রী হবেন। এমন উদাহরণ আছে। কিন্তু হওয়ার অপশন রাখা উচিত। আর প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন, তিনিই সংসদ নেতা হবেন। এটা ট্রেডিশন। কোনো কোনো দেশ সংসদ নেতাকে আলাদা করেছে এমন নজির আছে। কিন্তু এখানে সংসদ নেতার কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। এখানে সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী অনেকটা অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ এটা প্রধানমন্ত্রীর মতো আলাদা পোস্ট নয়। কয়েকটা জায়গায় শুধু সংসদ নেতার উল্লেখ আছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা আমরা বলেছি। যেখানে রাষ্ট্রপতির হাতে কি কি ক্ষমতা অর্পন করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রপতি কি কি করতে পারবেন সেটা বিস্তারিত থাকবে। এটা এই মুহূর্তে আমরা উন্মোচন করছি না।
দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে বিএনপি একমত বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আইনসভার ক্ষেত্রে ওনারা নাম রেখেছেন উচ্চ কক্ষের জন্য সিনেট, নিম্ন কক্ষের নাম জাতীয় সংসদ। এটাতে আমরা একমত। নিম্ন কক্ষের ৪০০ আসেন মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এটা নিয়ে আমরা একমত, তবে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মধ্যে ভিন্নমত আছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ১৪ জন হবে, এর সাথে একমত। উপদেষ্টা মন্ডলীর কার্যাবলীর রুটিন ওয়ার্কের ক্ষেত্রে একমত। প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য থেকে একজনকে মনোনীত করা হবে, সেই বিষয়ে একমত। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে একমত। স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করা হবে না, এই ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ একমত। তিনি আরো বলেন, শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আমরা মোটামুটি একমত। তবে এটা আরো বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। কারণ শৃখলাবাহিনী বলতে সশস্ত্র বাহিনীর তিন বিভাগসহ পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত আছে। সুতরাং ঢালাওভাবে শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে একটি প্রোভেশন রাখি হঠাৎ করে, তাহলে ইনব্যালেন্স হয়ে যেতে পারে। সেজন্য এটা আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। একটি জিনিসে ঐক্যমতে আসা যায়৷ কিন্তু যেটা রাষ্ট্রের বিষয়, সংবিধধানের বিষয়, রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয় সেটা গভীরভাবে চিন্তা করে সংবিধানে আনতে হবে।
বিচার বিভাগ নিয়ে সুপ্রীম কোর্টের সব উদ্যোগকে যাতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় যায় সেই আহ্বান জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যাতে কোনভাবেই বিচার বিভাগ কর্তৃক সংবিধানের কোন কার্যক্রম আইনানুগ হয়, অসাংবিধানিক না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখি। তিনি বলেন, আমরা আলোচনাটি দ্রুততার সাথে যাচ্ছিনা এইজন্য যে এটা রাষ্ট্রের বিষয়, এটা রিপাবলিকের বিষয়, এটা সংবিধানের বিষয়-তাড়াহুড়োত কোন বিষয় নয়। আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুপারিশ গৃহীত হবে। সেটা জাতীয় জীবনে মহান ভূমিকা রাখবে। সুতরাং একটু সময় বেশী নিলেও একটু প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
সংলাপের নতুন প্রস্তাব এসেছে : আলী রীয়াজ
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে নতুন নতুন প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি  অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে তিনি বলেন, আলোচনায় নতুন প্রস্তাব এসেছে। সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কারণ এগুলো সংস্কার কমিশনগুলোর কাছ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এসেছে।
প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় বিএনপি সঙ্গে কিছু বিষয়ে ও কিছু বিষয়ে একমত হওয়া গেছে জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে সামঞ্জস্যতা আছে, বেশ কিছু বিষয়ে মতভিন্নতাও আছে। মতভিন্নতার ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে অনেকগুলো ক্ষেত্রে তারা নীতিনির্ধারকদের কাছে যাবেন, আলোচনা করবেন এবং পরবর্তী সময়ে আমাদের জানাবেন।নিঃসন্দেহে আমরা ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত। এ সমস্ত সুপারিশের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্ত কেবল মাত্র এ টেবিল  (সংলাপ) থেকে হতে পারবে না। কারণ সংশ্লিষ্ট দলগুলোর ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকেরা অংশগ্রহণ করবেন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, অনেক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমরা অনেক জায়গায় ঐকমত্যের জায়গায় বা সামঞ্জস্যতার জায়গায় আসছি। কোথাও কোথাও ভিন্নমত আছে, সেটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, ১৫ টি দলের সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ পর্যায়ে এসেছে। বাকী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আশা করছি বিএনপির সঙ্গে তৃতীয় দিনে প্রাথমিক আলোচনা শেষ করতে পারব।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে হওয়া আলোচনার বিষয়বস্তু কমিশন প্রধান ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়মিত জানানো হয় উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, প্রতিট বিষয় প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়। প্রধান উপদেষ্টা দিক নির্দেশনাও দিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার প্রথম ও গত রবিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরআগে সংস্কার সুপারিশ চূড়ান্ত করতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ২০ মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এই সংলাপ শেষ হবে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন