জেলখাটা দূর্নীতিবাজ সাব রেজিষ্ট্রার সুব্রত সিংহকে বরখাস্তের পরিবর্তে প্রাইজপোষ্টিং

45
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

# কোটি টাকার বানিজ্যের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে ঘুষের এক লাখ টাকাসহ হাতেনাতে ধরা পড়ার পর কুষ্টিয়া সদরের সাব-রেজিস্টার সুব্রত কুমার সিংহকে আদালত কারাগারে পাঠালে ২০২০ সালে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল আইন মন্ত্রণালয়। এক মাস কারাগারে থেকে পরে জামিন পান তিনি। পরে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মন্ত্রনালয়কে ম্যানেজ করে চাকরি রক্ষা করেন তিনি। এর পরে স্বাক্ষর জালিয়াতি ও ভুয়া দলিলের মাধ্যমে দুই বোনের অন্তত ১০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি জবরদখলের ঘটনায় কুষ্টিয়ার এই সাবেক সাব রেজিস্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠিয়েছিলো আদালত। কুষ্টিয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তপন রায় তার জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে সন্ধ্যার দিকে তাকে কুষ্টিয়া জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তুু দূর্নীতির দায়ে কারাগারে গেলেও তাকে বরখাস্ত করা হয়নি। বরং বরখাস্তের পরিবর্তে তাকে গত ২৮ এপ্রিল দিনজাপুর থেকে প্রাইজ পোষ্টিং হিসেবে রংপুর সদরে বদলী করা হয়। অভিযোগ রয়েছে বরখাস্ত আদেশ এর পরিবর্তে এই প্রাইজপোষ্টিং এর জন্য কোটি টাকার বানিজ্য হয়েছে।

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার আমলে আওয়ামী লীগের লোক পরিচয় দিয়ে দাপট দেখানো সুব্রতকে শাস্তির পরিবর্তে এই প্রাইজ পোস্টিং এর খবরে নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। তার বদলী আদেশ বাতিল করে তার বিরুদ্ধে দূদক এর মামলা দ্রুত শেষ করে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সংস্লিষ্টরা।
সংস্লিষ্টরা জানান, সুব্রত কুমার সিংহ (৪৬) দিনাজপুরের সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামের দুর্গাপদ সিংহের ছেলে। কুষ্টিয়ায় কর্মরত অবস্থায় তিনি এ দুর্নীতি অনিয়ম করেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

মামলায় আসামিরা হলেন, কুষ্টিয়া সদর উপজেলার মনোহরদিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সাবেক কর্মকর্তা মেসবাহুর রহমানের (৫৫)। তিনি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দুর্বচরা গ্রামের মৃত শাহ উজির উদ্দিনের ছেলে। একই উপজেলার লাহিনী গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে শামসুল ইসলাম (৩০), দুর্বাচারা গ্রামের শাহ খলিলুর রহমানের ছেলে শাহ ইউসুফ হোসাইন (৩২), লাহিনী গ্রামের আক্তার খাঁর ছেলে সাদ্দাম খাঁ (৩১), লাহিনী গ্রামের মৃত সামাদ খার ছেলে আক্তার হোসেন (৬১), একই গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে তানভির হোসেন (২৩), নড়াইল জেলার মাধবপাশা গ্রামের হামিদুল হকের ছেলে এসএম জিয়াউর রহমান (৪১), তার স্ত্রী সুমনা (৩০), কুষ্টিয়া সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাবেক সাব রেজিস্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহ, একই অফিসের অফিস সহকারী রফিকুল ইসলাম মুকুল, পিয়ন নুরুল ইসলাম খোকন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পায়। ভুক্তভোগীরা হলেন, কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার হরিনারায়ণপুর ইউনিয়নের বেড়বাড়াদী গ্রামের মৃত নিয়ামত আলী শেখের মেয়ে জামিলা নাহার শেখ ও জুবাইদা নাহার শেখ। জুবাইদা নাহার শেখ অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এবং জামিলা নাহার শেখ চাকরিজীবী। মামলার বাদী জুবাইদা নাহার শেখ।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১০ মার্চ ও একই বছরের ১৯ জুন বিকালে কুষ্টিয়া সাব রেজিস্ট্রার অফিসে ভূমি অফিস ও তহসিল অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে ভুয়া দলিলের মাধ্যমে নামজারি তৈরি করে দুই বোনের প্রায় দশ কোটি টাকার মূল্যের ২৮ বিঘা পৈতৃক জমি ও পেট্রলপাম্পের জমি আত্মসাতের চেষ্টা করে। তাদের জালিয়াতির বিষয়টি জানাতে পেরে ভুক্তভোগীরা আদালতের দ্বারস্থ হন।

আদালতের নির্দেশে মামলাটি কুষ্টিয়া পিবিআই অনুসন্ধান শুরু করে। মামলাটি অনুসন্ধানে নেমে কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে আসে সাপ। ভুক্তভোগী দুই বোনের স্বাক্ষর ও টিপসই জাল জালিয়াতি করা হয়। দুই বোনের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা দীর্ঘ তেইশ বছরের বিশ্বস্ত কর্মচারী এসএম জিয়াউর রহমান ও তার প্রথম স্ত্রী সুমনাকে বিক্রেতা সাজিয়ে গুলশানের একটি বাড়িতে জালিয়াত চক্রের উপস্থিতিতে (একজনকে দিয়েই) দুজন দাত্রীর স্বাক্ষর ও টিপসহি প্রদান করে। জালিয়াত চক্র জমির নামজারি সম্পন্ন করে। তারপর জালিয়াত চক্রের সদস্য ও দলিল গ্রহীতারা কয়েকগুণ উচ্চ মূল্যে অন্যান্যদের নিকট পেট্রোল পাম্পসহ জমি বিক্রি করে বিপুল অংকের টাকা আত্মসাৎ করে। তদন্তে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পান তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই কর্মকর্তা রবিউল আলম। তদন্ত শেষে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তিনি। স্বাক্ষর জালিয়াতি ও ভুয়া দলিলের মাধ্যমে দুই বোনের প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি জবরদখলের চেষ্টা করেন আসামিরা।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী কামরুল ইসলাম, আদালত পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, সাব রেজিস্ট্রার সুব্রত কুমার সিংহকে গত ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট থেকে চিফ জুডিশিয়াল আদালতে ৬ সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার আদেশ প্রদান করা হয়। বুধবার তিনি আদালত হাজির হলে বিচারক তার জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, সুব্রত কুমার সিংহ মোটা অংকের টাকা খরচ করে মন্ত্রনালয়কে ম্যানেজ করে জেলে যাওয়ার পরও বরখাস্ত হননি। দুই দফায় জেলে যাওয়ার পর তার চাকরি থাকার কথা নয়। বিশেষ করে দুদক ঘুষসহ হাতে নাতে গ্রেফতারের পরও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রভাব বিস্তার করে তিনি বহাল তবিয়তে ছিলেন। কিন্তুু পটপরিবর্তনের পর জেলে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলে যাওয়ার পর দেশের জাতীয় দৈনিক গুলোতে বড় করে সংবাদ প্রকাশিত হলেও তাকে বরখাস্ত না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অনেকে। কারণ কোন সরকারি কর্মকর্তা এক দিনের জন্য জেলে গেলেও তাকে বরখাস্ত হতে হয়।

এবিষয়ে নিবন্ধন অধিদপ্তরের আইআরও (রাজশাহী বিভাগ) মতিউর রহমান বলেন, সাব রেজিষ্ট্রার যে জেলে ছিলেন তা তাদেরকে জানানো হয়নি। অধিদপ্তর যেহেতে অফিসিয়ালি জানে না যে তিনি জেলে গেছেন তাই তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি।

ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে ধৃত সুব্রত কুমার সিংহ:
এর আগে কুষ্টিয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে ধৃত সাব-রেজিস্টার সুব্রত কুমার সিংহকে ২০২০ সালে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে।  জানা যায়, ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া দুদকের উপ-পরিচালক মো. যাকারিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে কুষ্টিয়া সদর সাব-রেজিস্টার সুব্রত কুমার সিংহ ও অফিস সহকারী রফিকুল ইসলামকে ঘুষের এক লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় এক মাস কারান্তরীন থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়ে সুব্রত কুমার সিংহ স্বপদে যোগ দেন।

পরে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৬ কর্তৃক সচিব (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো. গোলাম সারওয়ার স্বাক্ষরিত পত্রে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় সাব-রেজিস্টার সুব্রত কুমার সিংহ গ্রেফতার ও কারাগারে আটক থাকায় সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৩৯ (২) ধারা মোতাবেক আটকের তারিখ হতে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বলে প্রেরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়। এর আগে অফিস সহকারী রফিকুল ইসলাম সাময়িক বরখাস্ত হন।

শেয়ার করতে ক্লিক করুন