নিজস্ব প্রতিবেদক:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপোড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের পর আপাতদৃষ্টিতে তা অনেকটা কেটেছে। ঐ বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের মধ্যে অনেকগুলো শব্দের ‘মারপ্যাচ’ রয়েছে। তাহলো ‘সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে’ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা যেতে পারে। তাই ঘোষিত ঐ সময়ে নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে এখনো সংশয় রয়ে গেছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। কারণ নির্বাচন নিয়ে জামায়াত ও এনসিপি আরও সময় নেয়ার পক্ষপাতী। আর বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল চায় দ্রুত নির্বাচন। পাশাপাশি কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও আওয়ামী লীগ চায় ‘ইউনূস সরকারের দ্রুত বিদায়’। এসব কারনে সামনের সময়টায় ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও জটিল’ হয়ে উঠতে পারে। তাই জটিলতা এড়াতে ডিসেম্বরের আগেই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচনী তফসিল ঘোষনার পরামর্শ নিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
ড. ইউনুসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী অভিযোগ করেছে, বিএনপির সাথে আলোচনা করে সরকার যেভাবে ব্রিফিং ও বিবৃতি দিয়ে বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছে তাতে একটি বিশেষ দলের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন করেছে। অন্যদিকে, নব গঠিত দল এনসিপি বলেছে, ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। দলটি অভিযোগ করেছে, সরকার একটি দলের দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
তবে এই বৈঠকে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বিএনপির গত কয়েক মাসের বাড়তে থাকা বিরোধ মিটমাট হয়ে যাওয়ায় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা। ডিসেম্বরের মধ্যে ভোটের দাবিতে সরব থাকা দলগুলোও এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের আশা নির্বাচনের সময়কে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে যে উত্তেজনার আঁচ বাড়তে শুরু করেছিল তা এখন কেটে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, সংলাপের মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের যে ধারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত, সেখানে লন্ডনের বৈঠকের মাধ্যমে পরিবর্তনের হাওয়া লাগল। নির্বাচনের তারিখের ক্ষেত্রে বিএনপি এবং সরকার তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এটাই হল সবচেয়ে বড় দিক। এ সরকারের তো বেশি দিন থাকার দরকার নাই। কারণ, নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক উত্তরণটাই হল তার কাজ। তিনি বলেন, সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই ক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে জানাতে হবে যে, তারা কোন কোন সংস্কারের ক্ষেত্রে একমত হয়েছে। এগুলো পরবর্তী নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার বাস্তবায়ন করবে। বিষয়টা হলো কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হটানো দরকার এবং আগামীতে যাতে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার ফিরে না আসে, সেটাও নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু সিদ্ধান্তে আসা দরকার।
সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে দ্বিমত ছিল। ড. ইউনূস বলেছিলেন আগামী বছরের এপ্রিলে নির্বাচন দেবেন। আর তারেক রহমান চেয়েছিলেন এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া হোক। কাজেই এই বিরোধ মেটানো দরকার ছিল। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া বিশ্লেষণে তিনি বলেন, লন্ডনে ড. ইউনুসের সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের পর যৌথ ব্রিফিং এ বলা হয়েছে, তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রস্তাব রেখেছেন আগামী রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের। এর জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ২০২৬ সালে রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। মাসুদ কামাল বলেন, এখানে অনেকগুলো শব্দের মারপ্যাচ আছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সংস্কার ও বিচারের পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। বিচার আসলে কার উপর নির্ভর করছে, বিচার কে করছে? বিচার তো করছে আদালত। আদালতকে কি বিচারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যায়? যদি বিচারের অগ্রগতি না হয়, তাহলে কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না? এই বিষয়গুলো অস্পষ্ট। তাই নির্বাচন হতে পারে ফেব্রুয়ারিতে, তবে এখানে কিছু ‘যদি’ ও কিন্তু রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, তারেক-ইউনূস বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো সরকার ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা এবং এর ফলে বিএনপির আর রাস্তায় আন্দোলনে নামার সুযোগ থাকলো না। একদিকে বিএনপির নেতৃত্ব তারেক রহমানের হাতে, এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে সরকার নিশ্চয়তা পেয়েছে বিএনপি রাস্তায় নামছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, সরকারের অনেকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হোক এটা খুব বেশি চাইবেন না। এই সরকারের কিছু লোক আছে যারা ফেব্রুয়ারি না, এপ্রিলেও না, তারা জুন এবং পারলে ২৭ সালের ডিসেম্বরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্তে তাদের অনেকেরই এক অর্থে পরাজয় হয়েছে। তাই এটা নিয়ে তাদের অনেকেই উচ্ছ্বাস দেখাবে না। তিনি আরও বলেন, জাপানে প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে বিএনপিকে ভিক্টিমাইজ করার চেষ্টা করছিলেন, উনি অভিযোগ করছিলেন নাম না তুলে-পরিস্থিতি খুবই কঠিন জায়গা চলে গিয়েছিল। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। তবে ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে আসায় রাজনৈতিক সংকট কেটেছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক সোহরাব হাসান মনে করেন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে মতৈক্যের বিষয়টিই সরকার তথা প্রধান উপদেষ্টার বড় সাফল্য। তিনি বলেন নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রে উত্তরণের কোনো বিকল্প উপায় আছে বলে জানা নেই। নির্বাচন দুই মাস পর হলে সব সংস্কার বা বিচারকাজ শেষ হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এপ্রিলে নির্বাচন করার সমস্যাগুলো প্রায় সব দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। তাই নির্বাচনের সময় এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল ও সংগঠনের সম্মতি ও সমর্থন নিয়েই মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারা সব সময় নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছে বলে মনে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাহলে এবারও কি বিএনপির চাপের কাছে সরকার নতিস্বীকার করল কি না সেই প্রশ্নও উঠবে।
##