রফিকুল ইসলাম সবুজ:
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফায় দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হলেও জাতীয় নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এটি কার্যকরের যে প্রস্তাব তাতে জোর আপত্তি জানিয়েছে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। এই অধ্যাদেশে বিশেষ সাংবিধানিক অঙ্গীকার যা অন্য সব আইন ও আদালতের রায়ের ঊর্ধ্বে ‘জুলাই সনদের’ সর্বোচ্চ আইনগত প্রাধান্য নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ থাকবে। দলগুলোর নেতারা বলছেন কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল সংবিধানের ওপরে স্থান পেতে পারে না। কারণ সংবিধান হচ্ছে সব আইনের উপরে। জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হলে এটা খারাপ নজির তৈরি হবে এবং ভবিষ্যতে উচ্চ আদালতে গেলে তা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়া এ সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, সরাসরি এমন বিধান রাখারও বিপক্ষে বেশির ভাগ দল। সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা থাকায় এতে সব দল স্বাক্ষর করবে কি না তা নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে ভোটের আগে সনদ বাস্তবায়নের উপায় খুজে পাচ্ছে না ঐকমত্য কমিশন।
এমন পরিস্থিতিতে সনদের চূড়ান্ত খসড়ার বিষয়ে মতামত জানানোর সময় বুধবার শেষ হয়েছে। সনদ বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণে দলগুলোর সঙ্গে আগামী সপ্তাহে আবারও তৃতীয় দফায় সংলাপে বসবে ঐকমত্য কমিশন। এই বৈঠকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ভোটের আগে নাকি নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়িত হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে সম্প্রতি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। তাদের সঙ্গে কথা বলে সনদ বাস্তবায়নের চারটি বিকল্প পথ পাওয়া গেলেও তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-গণভোট, সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স, বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থা ও অধ্যাদেশ জারি। তবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে বর্তমানে বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও সংসদ অনুমোদন না দিলে তা কার্যকারিতা হারাবে। আর অধ্যাদেশের বিপক্ষে অধিকাংশ দল।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি বলছে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামীর নির্বাচন দাবি করছে। সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন ছাড়া জুলাই সনদে তারা স্বাক্ষর করবে না বলেও জানিয়েছে। জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে একটি অধ্যাদেশ জারির জন্য সবগুলো রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতি চাইছে ঐকমত্য কমিশন। এই অধ্যাদেশে থাকবে বিশেষ সাংবিধানিক অঙ্গীকার যা অন্য সব আইন ও আদালতের রায়ের ঊর্ধ্বে ‘জুলাই সনদের’ সর্বোচ্চ আইনগত প্রাধান্য নিশ্চিত করবে। সনদ বাস্তবায়নে ৯ দফা অঙ্গীকারের বিধান রাখা হয়েছে যা সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। সনদের সর্বশেষ খসড়া অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিশ্রুতি দিতে বলা হবে যেন, এটি বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে পুরোপুরি আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। যদি সনদের কোনো শব্দ, বাক্য বা নীতি সংবিধান বা অন্য কোনো আইন-বিচারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে সনদের বিধানই অগ্রাধিকার পাবে।
জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় নতুন নতুন অঙ্গীকার সংযুক্ত করায় সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। পাশাপাশি কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। কিছু কিছু বিষয় আলোচনা না হলেও তা জুলাই সনদে রাখা হয়েছে। আগামী সংসদ গঠনের দুইবছরের মধ্যে সংবিধান সংক্রান্ত সংশোধনী পাশ করার কথা বলা হলেও চূড়ান্ত খসড়ায় তা নেই। তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারকে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাকে সাংবিধানিক রূপ দিতে হলে সংসদে যেতে হবে। তিনি বলেন, জুলাই সনদে উত্থাপিত ৮৪ দফার মধ্যে যেসব দফায় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট এসেছে সেগুলোর সুরাহা কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কার বিষয়ক যেসব কথা এসেছে তার বাস্তবায়ন কীভাবে, সেটা এখন জরুরি। তাছাড়া দ্বিতীয় দফার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গীকারনামায় সনদকে সংবিধানের উপরে রাখা হয়েছে। তবে কোনো ডকুমেন্ট সংবিধানের উপরে হতে পারে না। যদি সনদ সংবিধানের উপরে রাখা হয়, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হবে। জুলাই সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে বলা হয়েছে, এটাও সঠিক হয়নি।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দলগুলোর বৈঠকে কথা হয়েছিল, যেসব বিষয়ে সবাই মিলে একমত হব, সেটিই হবে ঐকমত্য। যার ভিত্তিতে সনদ স্বাক্ষর হবে। কিন্তু সনদের খসড়ায় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া এবং আদর্শিক বিষয়ে ঘোরতর দ্বিমত পোষণ করার বিষয়কে ঐকমত্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতির প্রশ্নে ঐকমত্য সম্ভব নয় বলে তারা তা আলোচনার বাইরে রাখার প্রস্তাব দিয়ে সভা বর্জন করেছিলেন। অথচ এর পরও ওই চার মূলনীতি পরিবর্তনের সম্মতি নেওয়ার কথাই বলা হয়েছে, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এর মাধ্যমে সনদের পক্ষে থাকা অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। এবিষয়ে বামদলগুলোর পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়ে লিখিত মতামত দেওয়া হবে। তারপর সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।
জুলাই সনদ দেশের ভবিষ্যৎ ও নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সনদ নিয়ে তাদের কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এগুলো নিয়ে তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কথা বলবেন। প্রধান ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই একমত হয়েছে। জুলাই সনদ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য ও নির্বাচনের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, জুলাই সনদে যদি আইনি ভিত্তি দেওয়া না হয় এবং এখন থেকে এটা বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে দলগুলো যত জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সেগুলোর কোনো প্রতিফলন ঘটবে না। তার মতে, সংস্কার বাস্তবায়নে দেরি করা সুষ্ঠু নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হতে পারে।
গত ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে ৪৫টি বৈঠকে ৬২টি বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে ঐকমত্য কমিশন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ২৩টি বৈঠকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি ইস্যুতে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে কমিশন। এর মধ্যে ৮টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। বাকি ১১টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ দলের মতামতের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন।
একমত হওয়া সিদ্ধান্ত গুলো হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু, কোন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর, নির্বাচন কমিশন গঠনে বাছাই কমিটি গঠন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, স্বাধীন পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন, জরুরি অবস্থা ঘোষণাসংক্রান্ত সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা প্রদানের জন্য আইন সংশোধন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণে কমিটি গঠন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন এবং উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত গঠন।
আর যে ১১টি বিষয়ে ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়ন পদ্ধতি, সংবিধানের মূলনীতি, প্রধান বিচারপতি মনোনয়ন, সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান এবং সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। বিএনপির এসব আপত্তিতে সমর্থন জানিয়েছে সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোটসহ আটটি দল।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই সনদ’ আইনি দলিল হবে কি না সে বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি, আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের তৃতীয় ধাপের আলোচনার মাধ্যমে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সুত্র: সময়ের আলো।
##





