‘আপসহীন নেত্রী’ খালেদা জিয়ার জীবনাবসান : ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক

2
শেয়ার করতে ক্লিক করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মারা গেছেন; তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। মঙ্গলবার ভোর ৬টায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন। খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান, তারেকের স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান, তার দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমানসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সময় হাসপাতালে ছিলেন।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘আপসহীন নেত্রী’ অভিধা পাওয়া খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪১ বছর। তিনি পাঁচবারের সংসদ সদস্য, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী; আর বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন দুইবার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে নাম লেখানো খালেদা জিয়ার চার দশকের রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে রাজপথের আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। সংসদ নির্বাচনে একাধিক আসনে প্রার্থী হয়ে কখনো তিনি হারেননি। ১৯৯১ সালের বহু প্রতীক্ষিত সংসদ নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট করেন খালেদা জিয়া। পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই বিজয়ী হন। আর বিএনপি এ নির্বাচনে সংসদের বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে তিনি পাঁচটি পৃথক সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি যে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, সেখানেই তিনি জয়লাভ করেছিলেন।

লিভার সংক্রান্ত জটিলতা, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিস ও ইনফেকশনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন খালেদা জিয়া। গত ২৩ নভেম্বর থেকে তিনি বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মৃত্যুর সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ায়। অনেকেই শোক প্রকাশ করে পোস্ট দেন। বিএনপি নেতাকর্মী আর সমর্থকরা জড়ো হতে থাকেন এভারকেয়ার হাসপাতালের বাইরে।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিএনপি সাত দিনের শোক ঘোষণা করেছে জানিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয় সহ দেশের সকল কার্যালয়ে সাত দিন কালো পতাকা উত্তোলন থাকবে। দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীরা এই সাত দিনব্যাপী কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। প্রতিটি দলীয় কার্যালয় দেশনেত্রীর জন্য সাতদিন ব্যাপী কোরআন খতম ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে এবং জেলা পর্যায়ে দলীয় কার্যালয়ে শোক বই খোলা হবে।

৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক, বুধবার সাধারণ ছুটি:
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বুধবার থেকে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মঙ্গলবার উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় এ শোক পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া তাঁর জানাজার জন্য বুধবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার মাগফেরাতের জন্য আগামী শুক্রবার দেশের সব মসজিদে বিশেষ দোয়া আয়োজন করা হবে। অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও তার আত্মার শান্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্ম অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে, ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট। পারিবারিক নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। তার বাবা ইস্কান্দার মজুমদারের বাড়ি ফেনীতে হলেও তিনি জলপাইগুড়িতে বোনের বাসা থেকে পড়ালেখা করেন। পরে সেখানে চা ব্যবসায় জড়ান ইস্কান্দার; বিয়েও করেন তিস্তা পাড়ের শহরটিতে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর খালেদা জিয়ার পরিবার বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

খালেদা জিয়াকে দেশের ইতিহাসে ‘গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এক শোকবার্তায় বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে জাতি তার এক মহান অভিভাবককে হারাল। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, রাজনৈতিক সাফল্যের কারণেই বেগম খালেদা জিয়া চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন। মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় তাকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং দীর্ঘদিন কারাবাস করতে হয়েছিল।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমান। এক বছর পর ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন। তারেকও মুক্তি পেয়ে লন্ডনে চলে যান। দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৫ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। জিয়া-খালেদা দম্পতির আরেক সন্তান আরাফাত রহমান কোকো প্রয়াত হয়েছেন এক দশক আগেই।
জরুরি অবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়া যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাসিনাও কাছাকাছি সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেলেও খালেদা জিয়া যেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এটাই আমার ঠিকানা। এদেশ এদেশের মাটি মানুষই আমার সব কিছু । কাজেই আমি দেশের বাইরে যাব না।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে কারাগারে পাঠায় আদালত। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাতেও তার সাজার রায় হয়। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওই বছর ৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। পরে উচ্চ আদালত তাকে দুই মামলা থেকেও খালাস দেয়। ফলে তার দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হওয়ার কালিমা ঘোচে।

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৩, ফেনী-১ ও দিনাজপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হন খালেদা জিয়া। সোমবার ছিল নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। বিএনপির অন্যান্য প্রার্থীদের সঙ্গে খালেদা জিয়ার নামেও তিন আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়। তার পরদিনই তার মৃত্যুর খবর এলো।

 

শেয়ার করতে ক্লিক করুন