নিজস্ব প্রতিবেদক:
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনের যে প্রত্যাশা ছিল, তা বাস্তবে পূরণ হয়নি বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি’র পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদি সরকারের পতন হলেও, একই ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। বিচার, নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া হলেও অন্তর্বর্তী সরকার বিগত এক বছরে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সুশাসনের আলোকে বিচার ও প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেশ কিছু ঘাটতি দেখা গেছে। জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িতদের বিচারকাজে ধীরগতি এবং বাস্তবে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর জবাবদিহির অগ্রগতি না থাকা সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার ঘাটতি স্পষ্ট হয়েছে।
গতকাল সোমবার রাজধানী মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ সকল তথ্য তুলে ধরা হয়। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক উল্লেখ করে বলেন, মানুষ দীর্ঘসময় শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তারপরও সরকার কোনো স্পষ্ট রোডম্যাপ বা পরিকল্পনা প্রকাশ না করায় বিভিন্ন সময় জনগণ ও অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের মধ্যে ৫০টি আইন প্রণয়ন হলেও, শুধু নাম পরিবর্তনের জন্য ১৩টি অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। গুম সংক্রান্ত রিপোর্ট ও যাচাই-বাছাই শেষ হলেও বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার বিরুদ্ধে আলামত নষ্টের অভিযোগও রয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হতাহতের প্রকৃত তালিকা এক বছরেও চূড়ান্ত না হওয়াকে সরকারের বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখছে টিআইবি। টিআইবি’র পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব গত এক বছরে অনেক বেশি বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে নারীর অধিকার, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর সংস্কার কমিশনগুলো যেসব সুপারিশ দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। কোথাও কোথাও কিছু সুপারিশ বেছে নেওয়া হলেও অনেক জায়গায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংস্কার কমিশনগুলো নিয়ে বৈষম্য আছে। প্রথম গঠিত কমিশনগুলোর প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হলেও পরে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ গুরুত্ব পায়নি। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে একধরনের তড়িঘড়ি বা ‘অ্যাডহক’ মনোভাব দেখা গেছে। প্রশাসন চালাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতা স্পষ্ট হয়েছে। প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে একদলীয়করণ থেকে সরে এসে আরেক দলীয় প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা দেখা গেছে। এতে প্রশাসনে অস্থিরতা ও কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির আশংকা ॥ টিআইবি’র পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত এক বছরে গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন পক্ষের নিজস্ব এজেন্ডা সামনে আসায় মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্খা বাস্তবায়নের পথ আরো জটিল হয়ে পড়েছে। মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদও স্পষ্ট। এছাড়া সরকারের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়ের অভাব ও অস্থিরতা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। দলনিরপেক্ষ প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মব জাস্টিস বা গণপিটুনিতে মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে অভিহিত করা আইন-শৃঙ্খলার বড় ঘাটতি। মব তৈরি করে দাবি আদায়ের প্রবণতা সামাজিক অসহনশীলতা রোধে সরকারের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
টিআইবি জানিয়েছে, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার যে প্রত্যাশা ছিল, তা এখনো পূরণ হয়নি। জুলাই মাসে যে সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়ন এখনো সংবিধান ও আইনের দিক থেকে অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা কাঙ্খিত পরিবর্তনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। আরো বলা হয়, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মৌলিক সংস্কার নিয়ে এখনো গভীর মতপার্থক্য রয়েছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট রোডম্যাপের অভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে। পাশাপাশি অভ্যুত্থানে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধ ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে, যা সংস্কার প্রক্রিয়াকে আরো জটিল করে তুলেছে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত ॥ টিআইবি’র পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে জানানো হয়, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ৪৭১টি রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতায় ১২১ জন নিহত এবং ৫ হাজার ১৮৯ জন আহত হয়েছেন। এসব রাজনৈতিক সংঘাতের ৯২ শতাংশ ঘটনায় বিএনপি, ২২ শতাংশ আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী এবং এক শতাংশ ঘটনায় এনসিপির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়।
আরো বলা হয়, দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, আন্দোলন, লুটপাট, অরাজকতা চলছে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা (মব সন্ত্রাস), গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢালাওভাবে মামলায় আসামি হিসেবে নাম দেওয়া, গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ, রাজনৈতিক চাপ বাড়লে গ্রেপ্তার বৃদ্ধির অভিযোগ বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত আছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কার্যক্রমে বৈষম্য-কোনো পক্ষের প্রতি নমনীয় মনোভাব, কোনো পক্ষের ওপর নির্যাতন হয়েছে। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম আকরাম বলেন, আন্দোলনে নেতিবাচক ভূমিকার কারণে পুলিশের ভাবমূর্তির পতন হয়েছে। কিন্তু গত এক বছরে পুলিশ বাহিনীতে মৌলিক সংস্কারের পরিবর্তে কেবল পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলির বিষয়ে মনোযোগ ছিল। গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পহেলা মার্চ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করে ২১ দিনে সারা দেশে ১২ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু পরিস্থিতির বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। তিনি বলেন, ঢালাওভাবে মামলায় আসামি হিসেবে নাম দেওয়া, গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ, রাজনৈতিক চাপ বাড়লে গ্রেপ্তার বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত আছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কার্যক্রমে বৈষম্য কোনো পক্ষের প্রতি নমনীয় মনোভাব, কোনো পক্ষের ওপর নির্যাতন লক্ষ্য করা গেছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে ১১ মাসে ৭৬১ মামলা ॥ গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ১১ মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৭৬১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছে টিআইবি। টিআইবি’র তথ্যানুযায়ী, ওই সকল মামলায় মোট এক হাজার ১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৬১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
টিআইবি’র প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার ওপর হামলার নির্দেশদাতা, হত্যার ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা হয়েছে। এ পর্যন্ত এক হাজার ৬০২টি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩৮টি হচ্ছে হত্যা মামলা। এসব মামলায় পতিত সরকারের প্রায় ৮৭ জন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গ্রেপ্তার রয়েছেন। প্রায় ৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে ‘সন্তোষজনক অগ্রগতি’ হয়েছে এবং ৬০ থেকে ৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আরো বলা হয়, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪২৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে এবং ২৭টি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামি ২০৬ জন, যাদের মধ্যে ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের আগেই বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এতে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় অভিযুক্তদের বিচারও চলমান রয়েছে। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে এবং তাদের বিচার শুরু হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় (২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত) দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা ইতোমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক খাতে কাঙ্খিত স্বস্তি ফেরেনি ॥ অর্থনৈতিক খাতে কাঙ্খিত স্বস্তি ফেরেনি উল্লেখ টিআইবি জানিয়েছে, ব্যাংক খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের দাবি থাকলেও এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। দেশে রাজস্ব ঘাটতি এবং ঋণ খেলাপি পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। এমনকি কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও আয়করের তিন খাতেই লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হয়েছে। ঘাটতি গোপন করে দেশত্যাগে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা আশাব্যঞ্জক নয়। মূল্যস্ফীতির চাপ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রাজস্ব আদায়ে কোনো মাসেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং শিল্প-কারখানার বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনরত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে আসামি করে মিথ্যা মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার ও মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। আন্দোলনের পর বিভিন্ন থানায় হামলা, প্রতিশোধমূলক আটক ও জামিন না মঞ্জুরের ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
এনসিপি আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে ॥ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে জানিয়েছে টিআইবি। তবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অংশ হিসেবে সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত, জনগণের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপির বিকশিত হওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থের উৎসের অস্বচ্ছতা, দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, অনিয়মের বিদ্যমান সংস্কৃতি ধারণ করে আত্মঘাতী পথে ধাবিত হচ্ছে দলটি।
প্রতিবেদন তুলে ধরে টিআইবির গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন বলেন, নির্বাচনের তারিখ, সংস্কার ও অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিতর্ক ও সহনশীলতার ঘাটতিতে সংস্কার ও নির্বাচন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নির্বাচন, সংস্কার, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান অনড়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন, মতাদর্শিক লড়াই ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ, পুরাতন জোট ভেঙে নতুন নতুন রাজনৈতিক জোট বা বলয় তৈরির উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ও নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা পড়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে কোনো দল শর্ত পূরণ করতে পারেনি। এমনকি এনসিপিও নিবন্ধনের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি ॥ এখনো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি বলে জানিয়েছে টিআইবি। সংস্থাটি বলছে, বরং ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ও ভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। অবাধ তথ্য প্রবাহ ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ সময়কালে সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত ছিল। এ সময় ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হন, যাদের মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনের সময় হামলায় তিনজন সাংবাদিক নিহত হন। এছাড়া ২৪ জনের বেশি গণমাধ্যমকর্মীকে পদচ্যুত করা হয়, ১৫০ জনের বেশি সাংবাদিক চাকরি হারান এবং ৮টি সংবাদপত্রের সম্পাদক ও ১১টি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তা প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়।
টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সংঘবদ্ধ মব তৈরি করে বিভিন্ন গণমাধ্যম কার্যালয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকার তিন দফায় ১৬৭ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে। সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাংবাদিকদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ করা হয় এবং ২০২২ সালের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন নীতিমালা সংশোধন হলেও তা কার্যকরভাবে গণমাধ্যমবান্ধব হয়নি। পাশাপাশি তথ্য কমিশনকে সক্রিয় না করা এবং তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারে সরকারের উদাসীনতা স্পষ্ট।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ নিয়ে টিআইবি বলেছে, কিছু ধারা সংশোধন হলেও জাতিসংঘের সুপারিশ পুরোপুরি মানা হয়নি। অস্পষ্ট সংজ্ঞা রয়ে গেছে, যা মতপ্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় নিয়ন্ত্রণমূলক ও নজরদারিমূলক কাঠামো গঠনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত হয়নি। তথ্য গোপনের প্রবণতা এবং স্বপ্রণোদিতভাবে তথ্য প্রকাশ না করার চর্চা এখনো বহাল রয়েছে। এই পরিস্থিতিকে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগজনক।




