নিজস্ব প্রতিবেদক:
জুলাই জাতীয় সনদের পটভূমি ও অঙ্গীকার এবং মূলনীতিসহ সাংবিধানিক কিছু বিষয়ে একাধিক রাজনৈতিক দলের আপত্তি থাকার পরও নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই জাতীয় সনদের খসড়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সনদে স্বাক্ষর করেনি। দলগুলোর নেতারা নির্বাচিত সংসদের দুই বছরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে স্বাক্ষর করলেও এর কোন আইনী ভিত্তি থাকছে না। জামায়াত ও এনসিপি বর্তমান সরকার আমলেই আইনী ভিত্তি দিয়ে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে অনড় থাকলেও বেশির ভাগ দলই চাইছে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমেই এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলগুলোর মতৈক্যের কারণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। তারা মনে করেন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সংবিধান সংশোধন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ায় তারা নির্বাচিত হলে আপত্তি করা বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তাদের কোন দায়বদ্ধতা থাকবে না। একই ভাবে জামায়াতসহ অন্য দলগুলো যদি নির্বাচিত হয় তাদের ক্ষেত্রেও তাদের নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়ন নাও হতে পারে। তবে জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ে ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে বলে জানা গেছে।
গত ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে ৪৫টি বৈঠকে ৬২টি বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে ঐকমত্য কমিশন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ২৩টি বৈঠকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিষয়ভিত্তিক দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি ইস্যুতে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে কমিশন। এর মধ্যে ৮টি বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে। বাকি ১১টিতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ দলের মতামতের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন।
একমত হওয়া সিদ্ধান্ত গুলো হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু, কোন ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর, নির্বাচন কমিশন গঠনে বাছাই কমিটি গঠন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, স্বাধীন পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন, জরুরি অবস্থা ঘোষণাসংক্রান্ত সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা প্রদানের জন্য আইন সংশোধন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণে কমিটি গঠন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন এবং উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত গঠন।
আর যে ১১টি বিষয়ে ভিন্নমতসহ সিদ্ধান্ত হয়েছে তার মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়ন পদ্ধতি, সংবিধানের মূলনীতি, প্রধান বিচারপতি মনোনয়ন, সংবিধান সংশোধন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান এবং সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। বিএনপির এসব আপত্তিতে সমর্থন জানিয়েছে সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোটসহ আটটি দল।
অন্যদিকে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে স্বাক্ষর না করার পাশাপাশি সরকার ও কমিশনের বিরুদ্ধে মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে জামায়াত। এছাড়া সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ ও বাসদ (মার্কসবাদী) নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার পাশাপাশি সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনে আপত্তি জানিয়েছে। তারা মূলনীতির বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার ঘোষণাও দিয়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, সনদে জুলাই গণ-অভ্যুত্থাপনকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হলেও মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজনক ইতিহাসকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত হলেও এ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ রয়েছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের। সনদ বাস্তবায়নে দুই বছরের সময়সীমা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সংলাপে গণ অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে সনদের ভূমিকায় ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের বিষয়টি যুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, তাদের মূল কথা হচ্ছে জুলাই সনদকে আইনি মর্যাদা দিতে হবে এবং সেই মর্যাদার ভিত্তিতে এখন থেকেই ঐকমত্যের বিষয়গুলো কার্যকর করতে হবে। আইনি ভিত্তি না থাকলে এই সনদ মূল্যহীন হয়ে পড়বে। তাই আইনি ভিত্তি না দিলে জুলাই সনদে তারা স্বাক্ষর করবেন না। তার মতে গণভোট, অধ্যাদেশ জারি অথবা গেজেটের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে।
এনসিপি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির দাবি জানিয়ে বলেছে গণপরিষদ নির্বাচন অথবা গণভোট যেকোনো পদ্ধতিতে আইনি ভিত্তি দিতে হবে। দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, বিএনপি বলছে, তারা এটাকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে, সাংবিধানিক স্বীকৃতি নয়। অর্থাৎ, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি তারা দিতে চাচ্ছে না। আইনি ভিত্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হলে তারা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে কি না, সেটা পুনর্বিবেচনা করবেন।
তবে জাতীয় সনদের আইনী ভিত্তির দাবির বিরোধীতা করে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষর এবং দুই বছরের মধ্যে সুপারিশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকায় এই সনদের মর্যাদা আইনের ঊর্ধ্বে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই সনদ জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের দলিল। এটি সবার সম্মতিতে হচ্ছে। এই লিখিত ডকুমেন্টটা ওয়েবসাইটে যাবে, মিডিয়াতেও যাবে। এটা জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়। অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে বলেই তো জাতীয় ঐকমত্য হয়েছে। এটি যখনই চূড়ান্ত হয়ে তাদের কাছে আসবে, তখন তারা স্বাক্ষর করবেন। এই সনদ যেন বাস্তবায়িত হয়, সেই জন্য বিএনপি জাতির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার পরও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবশ্য আস্থা না থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই সনদের গেজেট প্রকাশ করা যেতে পারে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সংস্কার প্রশ্নে তারা ঐকমত্য কমিশনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ মুক্তি-সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দেওয়ার প্রশ্নে তারা ছাড় দিতে পারেন না। তাই শেষ মুহূর্তে সংলাপ বর্জন করেছেন। মূলনীতি বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব যদি বহাল থাকে, তাহলে সনদে তারা স্বাক্ষর করবেন কি না, সেটা তাদেরকে ভেবে দেখতে হবে।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দু’এক দিনের মধ্যেই জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর সই নেওয়া হবে। সনদে নাম ও পদবী উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করবেন। এরপর ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা এবং সর্বশেষ ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন। এরপর জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেটা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। এটি হবে রাষ্ট্রকে নতুন ধারায় পরিচালনার একটি গাইডলাইন বা নীতিমালা। এর সাংবিধানিক কোন ভিত্তি না থাকলেও এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার থাকবে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হবে। কারণ বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত পোষন করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। এছাড়া জামায়াত ও এনসিপিসহ অন্যান্য কয়েকটি দলও কয়েকটি সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। ফলে যে দল নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে তারা সনদের যে সব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ নয় অর্থাৎ তারা বাস্তবায়ন নাও করতে পারে। তারাতো আগেই জানিয়েছে যে তারা এই এই সুপারিশে একমত নয় তাই তাদের সেটা বাস্তবায়নে কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ফলে সনদের সব কিছুই বাস্তবায়ন হবে এটা ভেবে নেওয়া যাবে না। তাছাড়া সব দল সব বিষয়েই যে একমত হবে এটাও ঠিক না। প্রত্যেকটা দলের নিজস্ব নীতি আদর্শ রয়েছে ফলে তারা সব বিষয়ে একমত হবে না এটাই স্বাভাবিক।
সুুপ্রিমকোর্টের সাবেক রেজিষ্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, সংবিধান সংশোধনসহ জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হতে হবে। তা না হলে কোন সুপারিশই কার্যকর হবে না। যারা আগামী নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসবে মুলত তাদেরকে সনদের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। তারা বাস্তবায়ন না করলে জনগনের অর্থের অপচয় হবে এবং কমিশনের পন্ডশ্রম হবে। উদাহরন হিসেবে তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের অস্থায়ী সরকারের প্রধান সাহাবুদ্দিন সাহেব এর সরকার ২৮টি সংস্কার কমিশন করেছিল। কিন্তুু পরবর্তীতে আসা নির্বাচিত সরকার তেমন কোন সুপারিশই বাস্তবায়ন করেনি। একই ভাবে ওয়ান ইলেভেনের সরকার ১২২টি অধ্যাদেশ করেছিল কিন্তুু পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার মাত্র ৪৬টি আইনে পরিনত করেছিল। বাকি ৭৮টি অধ্যাদেশ আইনে পরিনত করেনি। ফলে এই ৭৮টি অধ্যাদেশ প্রনয়ন পন্ডশ্রম ও অর্থের অপচয় ছিল। তাই যে সংস্কারই করা হোক তা অর্থবহ করতে হবে এবং নির্বাচিত সরকার যদি সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে তা হলে পন্ডশ্রম হবে কমিশনগুলোর কার্যক্রম।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর। বিশেষ করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের। কমিশন দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখার অনুরোধ করেছে। এ ক্ষেত্রে কমিশন অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করবে। এর বাইরেও যতটুকু প্রয়োজন, সবাইকে সমন্বিত করে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।





