নিজস্ব প্রতিবেদক:
সারা দেশের সড়ক ও মহাসড়ক থেকে ৭৫ হাজার মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন সরিয়ে ফেলার যে উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার তা আপাতত বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পরিবহন মালিক- শ্রমিক নেতাদের চাপের মুখে সরকার নির্ধারিত অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান সড়কে চলাচল বন্ধে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হচ্ছে। রোববার সড়ক পরিবহন উপদেষ্টার সঙ্গে পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতাদের এক বৈঠকে দাবি দাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস পাওয়ার পর ১২ আগষ্ট থেকে ৭২ ঘন্টার পরিবহন ধর্মঘট কর্মসুচি প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে সংস্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কাজ শুরু করে। গত বছরের অক্টোবরে জানানো হয় মে মাস থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ঘোষণা দেন, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি সরিয়ে নিতে মালিকরা ছয় মাস সময় পাবেন। এ সময়ের পর সড়কে আর এসব গাড়ি চলতে পারবে না। গত এপ্রিলে মালিকদের দেওয়া ছয় মাস সময় অতিবাহিত হলেও রাস্তায় অবাধে চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। তবে নানামুখী সমালোচনা উপেক্ষা করে সড়কের শৃঙ্খলা আনতে সরকার ২০ জুলাই থেকে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলে ৮ দফা দাবিতে ধর্মঘটের হুমকি দেন পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা। তার পরেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পিছু হটে সরকার। এর আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলেও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানের সিদ্ধান্ত নিলেও পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের মুখে সরকার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। যাত্রীবাহী বাসের অর্থনৈতিক আয়ু ২০ বছর ও পণ্যবাহী গাড়ির ২৫ বছর নির্ধারণ করে ২০২৩ সালের মে মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল তৎকালীন সরকার। তবে পরিবহণ মালিকদের চাপে ৩ মাস পর প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৪ সালের ২৪ অক্টোবর বিদ্যুৎ ভবনে ‘ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে পুরোনো মোটরযান অপসারণ’ শিরোনামে এক সভায় ২০ বছরের পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের পুরোনো পন্যবাহী পরিবহন সড়ক থেকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে গত ৬ জুন পুরোনো যানবাহনের বয়সসীমার আগের প্রজ্ঞাপনটি বহাল করে।
সংস্লিষ্ট সুত্র জানায়, সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ ৭৫ হাজারের বেশি যানবাহনের মধ্যে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় ২০ বছরের পুরোনো বাস ও মিনিবাস রয়েছে ১০ হাজার ৫৫৬টি। এর বাইরে সারা দেশে আরও ১৮ হাজার ২০৫টি বাস ও মিনিবাস রয়েছে। এছাড়া ঢাকা মহানগর ও ঢাকা জেলায় ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংকলরির সংখ্যা ১৪ হাজার ৬৮৩। এর বাইরে সারা দেশে আরও ৩১ হাজার ৭৯৮টি পণ্যবাহী মোটরযান রয়েছে। অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া এসব যানবাহন শুধু সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটের জন্য দায়ী নয়, পরিবেশ দূষণেরও অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, রাজধানীতে বিনা বাধায় ফিটনেসবিহীন লক্করঝক্কর বাস চলতে দেখা একটি সাধারণ ঘটনা। রঙচটা, ভাঙ্গাচোড়া এসব বাসের বেশিরভাগেরই মেয়াদ ফুরিয়েছে ১ যুগেরও আগে। দেশের প্রচলিত আইনে ২০ বছরের পুরানো বাস ও ২৫ বছরের পুরানো ট্রাক সম্পূর্ন নিষিদ্ধ হলেও এ আইন মানছে না কেউই। বর্তমানে রাজধানীর বায়ুদূষণের অন্তত ৪০ ভাগের জন্য দায়ী এই কালো ধোঁয়া।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান বলেন, সড়কে বিশৃঙ্খলা ও বায়ুদূষণের জন্য এই মেয়াদোত্তীর্ণ ভাঙাচোরা বাসগুলোই দায়ী। অনেক বাস এতোই ভাঙাচোরা যে দেখতেই খারাপ লাগে। অথচ এদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এর দায়িত্ব সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরই। মেট্রো রেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় অবকাঠামোতে সরকার যতটা যত্নশীল ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনায় তা দেখা যায় না বলেই কেউ আইন মানে না। তিনি বলেন, প্রত্যেক রুটে যদি চাহিদা অনুযায়ী ভালোমানের বাস নামাতে পারি, তাহলে মেয়াদোত্তীর্ণ বাসগুলো সড়ক থেকে তুলে নেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা যানজটের শীর্ষে চলে গেছি, বায়ুদূষনেরও শীর্ষে চলে গেছি। এই অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, এখান থেকে বের হতে হলে আসলে আমাদের পলিসির দিকে জোর দিতে হবে এবং কমিটমেন্ট ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। কারণ লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহনকে ফিটনেস সনদ দিচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান আর সেই ফিটনেস সনদ নিয়েইতো এরা রাস্তায় নামছে সংশ্লিষ্ট অন্যদের ম্যানেজ করে।
সংস্লিষ্টরা জানান, পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস ও ট্রাক সড়ক থেকে উচ্ছেদে সব সময়ই বাধা হয়ে দাঁড়ান সড়ক পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকনেতারা। বিগত সময়ের মতো এখনোও তাঁরা সড়ক পরিবহন আইনের সাজা শিথিল করার জন্যও চাপ দিচ্ছেন। অথচ অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের আমলে লক্কড়ঝক্কড় বাস ও ট্রাক সড়ক থেকে উচ্ছেদ হবে এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কারণ বিগত সরকার আমলে পুরোনো বাস-ট্রাক উচ্ছেদের উদ্যোগ এবং সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের উদ্যোগ আন্দোলনের মাধ্যমে আটকে দিতেন দেন তৎকালীন সরকার সমর্থক পরিবহন নেতারা। সে সময় ধর্মঘটসহ নানা কর্মসুচির মাধ্যমে সড়ক পরিবহন আইনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নও করতে দেননি তাঁরা। আওয়ামী লীগ সরকার আমলের পরিবহন খাতের নেতারা বর্তমানে কারাগারে কিংবা আত্মগোপনে থাকায় এখন নেতৃত্বে আছেন বিএনপিপন্থী পরিবহন নেতারা। তারাও বিগত আমলের পরিবহন নেতাদের মতো সরকারকে জিম্মি করে দাবি আদায় করে নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) গত ২০ জুলাই ২০ বছরের পুরোনো বাস-মিনিবাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান উচ্ছেদে অভিযান শুরু করলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে ১২ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে ৭২ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটের হুমকি দেয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব মো. সাইফুল আলম যানবাহনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ ও ২৫ বছর এর পরিবর্তে তা বাড়িয়ে ৩০ বছর করাসহ আট দফা দাবি জানিয়ে ১১ আগস্টের মধ্যে দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সেটা না হওয়া পর্যন্ত পুরোনো গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান স্থগিত রাখতে হবে। এছাড়া সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সাজার যে ধারা রয়েছে, তা সংশোধন করতে হবে, দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মালিকের জিম্মায় দেওয়ার বিধান কার্যকর করতে হবে, মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের জন্য স্ক্র্যাপ নীতিমালা প্রণয়ন করা, মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন ও অনুমোদনহীন হালকা যানবাহনের জন্য আলাদা লেন তৈরি করা।
এদিকে রোববার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে সরকারের সঙ্গে পরিবহন মালিকদের বৈঠকে বাণিজ্যিক মোটরযানের ‘অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল’ ৩০ বছর করাসহ আট দফা দাবি পূরণের ‘আশ্বাস’ পেয়ে মঙ্গলবার থেকে ডাকা তিন দিনের পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানিয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দাবিগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে বিবেচনা করবো। মালিকেরা আমাদের কথায় আশ্বাস পেয়েছেন, ফলে তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন।
পরিবহন শ্রমিক নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেন, সরকারকে জিম্মি করে কোনো কিছু আদায় করা উচিৎ নয়। সরকারের সব সিদ্ধান্ত আইনানুগ প্রয়োগ হবে। আমাদের যুক্তিসংগত দাবিগুলো একাধিক বৈঠক করে সরকার আমলে নেওয়ায় তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন।





